জন্মের পরদিনই বাবা কানে দিয়েছিলেন ‘মন্ত্র’, জাকিরের তালে ‘বাহ উস্তাদ’ বলতে বাধ্য হয়েছিল গোটা দুনিয়া

Zakir Hussain: তিনি 'শক্তি' ব্যান্ডেরও সদস্য ছিলেন। জন ম্যাকলাফলিন, শঙ্কর মহাদেবন, ভি সেলভাগণেশন, গণেশ রাজাগোপালানের এই ইন্দো-জ্যাজ ব্যান্ডের দিস মোমেন্ট অ্যালবাম এই বছরই গ্রামি পুরস্কার জেতে সেরা গ্লোবাল মিউজিক অ্যালবাম হিসাবে।

জন্মের পরদিনই বাবা কানে দিয়েছিলেন 'মন্ত্র', জাকিরের তালে 'বাহ উস্তাদ' বলতে বাধ্য হয়েছিল গোটা দুনিয়া
উস্তাদ জাকির হুসেন।Image Credit source: TV9 বাংলা
Follow Us:
| Updated on: Dec 16, 2024 | 10:44 AM

নয়া দিল্লি: শিল্পী পরিবারে জন্ম। রক্তে মিশেছিল সেই সত্ত্বা। সেই কারণেই নিজের ভিতর থেকে শিল্পীসত্ত্বাকে খুঁজতে বেশি সময়  লাগেনি। নেশাকেই পেশা বানিয়েছিলেন তিনি। আর তার জন্যই হয়তো আজ সকলের উস্তাদ তিনি। উস্তাদ জাকির হুসেন। ভারতের এই প্রতিভা বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছিলেন যে শুধু সঙ্গীতকে সঙ্গত দেওয়ার জন্য নয়, বাদ্যযন্ত্রই আলাদা সঙ্গীত হয়ে উঠতে পারে।

উস্তাদ জাকির হুসেন। তাঁর নামই যথেষ্ট ছিল পরিচয়ের জন্য। তিনিই বাঙালিকে বাধ্য করেছিলেন শীতের রাতেও অপেক্ষা করতে শুধুমাত্র তাঁর তালের মূর্ছনা শোনার জন্য। কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী আল্লা রাহার সন্তান তিনি। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর যখন তাঁকে বাবার কোলে দেওয়া হয়েছিল, তখন কোনও বিশেষ প্রার্থনা বা ভাল মানুষ হওয়ার কথা বলেননি আল্লা রাহা। বলেছিলেন, তবলার বোল “ধাগে তেটে, ধাগে তেটে, ক্রিধা তেটে”। সেই থেকে শিক্ষার শুরু। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলি খাঁ-সাহিব রেখেছিলেন তাঁর নাম।

জাকির হুসেন নিজেই বলেছিলেন যে শিল্পী পরিবারে জন্ম তাঁর, তাই ছোট থেকেই সঙ্গীত তাঁর জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। তবলায় হাত রেখেছিলেন তিন বছর বয়সে। বাবা আল্লা রাখার কাছে শিক্ষা শুরু সাত বছর বয়স থেকে। বাবার কাছে যখন তালিম নিতে বসতেন, তখন সম্পর্কটা শুধুই গুরু-শিষ্যের হত।

বাবা আল্লা রাখার সঙ্গে জাকির হুসেন।

বহু শিল্পীই জাকির হুসেন সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন যে তাঁকে দেখে শেখা যায় মাটির মানুষ কেমন হয়। বিশ্বখ্যাত শিল্পী হয়েও, শিকড় ভোলেননি কখনও। এর কারণ হয়তো তাঁর শিক্ষা। ভোর তিনটে সময় বাবা ঘুম থেকে তুলে দিতেন। ছ’টা পর্যন্ত চলত তালিম। দেবী সরস্বতী, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে পরিচয় সেখান থেকেই। এরপর সকাল সাতটায় স্কুলে যেতেন। স্কুলে যাওয়ার পথেই মাদ্রাসায় পড়তেন কোরান। পড়াশোনা সেন্ট মাইকেল হাইস্কুলে। বাকিদের সঙ্গে তিনিও চার্চে গিয়ে প্রার্থনা করতেন। ধর্মের বিভেদ বোঝেননি কোনওদিনই।

১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয় জাকির হুসেনের প্রথম অ্যালবাম ,”লিভিং ইন দ্য মেটেরিয়াল ওয়ার্ল্ড”। সেই থেকে শুরু। ১৯৭৯ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে একাধিক জাতীয়, আন্তর্জাতিক ফেস্টিভালে যেমন তিনি পারফর্ম করেছেন, তেমনই অগুনতি অ্যালবামও প্রকাশ করেছেন ছয় দশকের কেরিয়ারে। তবে কেরিয়ারে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মুহূর্ত ছিল ১৯৭৩ সালে গিটারিস্ট জন ম্যাকলাফলিন, ভায়োলিন বাদক এল শঙ্কর ও  ঘটম বাদক টিএইচ ভিক্কুর সঙ্গে যুগলবন্দী। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে জ্যাজের মেলবন্ধন ছিল, যা ওই যুগে কেউ কল্পনাই করতে পারত না।

তিনি ‘শক্তি’ ব্যান্ডেরও সদস্য ছিলেন। জন ম্যাকলাফলিন, শঙ্কর মহাদেবন, ভি সেলভাগণেশন, গণেশ রাজাগোপালানের এই ইন্দো-জ্যাজ ব্যান্ডের দিস মোমেন্ট অ্যালবাম এই বছরই গ্রামি পুরস্কার জেতে সেরা গ্লোবাল মিউজিক অ্যালবাম হিসাবে।

গ্রামি হাতে টিম শক্তি।

এই একবারই নয়, মোট সাতবার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন তিনি। চারবার এই আন্তর্জাতিক সম্মান পান। ১৯৮৮ সালে তিনি পদ্মশ্রী সম্মান পান। ২০০২ সালে পান পদ্মভূষণ সম্মান। আর ২০২৩ সালে তাঁকে পদ্মবিভূষণ সম্মান দেওয়া হয়। ভারতীয় সঙ্গীতে অবদানের জন্য সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি।

শুধু তবলাবাদক হিসাবেই নয়, তিনি অভিনেতা-মডেলও ছিলেন। ১৯৮৩ সালে ‘হিট অ্যান্ড ডাস্ট’-এ প্রথম অভিনয়। মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন ১৯৯৮ সালে, রাহুল দেব বর্মণের জীবনের উপরে তৈরি ‘সাজ’ সিনেমায়, সেখানে রাহুল দেব বর্মণের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। এ বছর দেব পটেলের মাঙ্কি ম্যান সিনেমাতেও নিজের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ১৯৯০-র দশকে ব্রুক বন্ড চায়ের বিজ্ঞাপন করেছিলেন তিনি। সেখান থেকেই লোকমুখে জনপ্রিয় হয়েছিল “বাহ তাজ”।

শিল্পীর শেষ হলেও, শিল্প অবিনশ্বর। তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হয়ে থাকবেন জাকির হুসেন।