নয়া দিল্লি: সোমবারই, জানা গিয়েছিল, তৃতীয় মেয়াদেই ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ কার্যকর করবে মোদী সরকার। তার একদিন পরই, বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর), এই বিষয়ে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বাধীন কমিটির প্রস্তাব অনুমোদন করল কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। এরপর প্রস্তাবটি, সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে একটি বিল আকারে পেশ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে, সেই বিল পাশ করাতে মোদী সরকারকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হতে পারে। কারণ, মোদী সরকার দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবস্থা চালুর পক্ষে সওয়াল করলেও, বিরোধী শিবির থেকে এই প্রস্তাব নিয়ে বেশ কিছু ওজর-আপত্তি আছে। আসলে, এই ব্যবস্থায় সময়, অর্থ ও সম্পদ বাঁচলেও, এক দেশ এক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করার বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও রয়েছে।
প্রথমত, এটি কার্যকর করতে গেলে সাংবিধানিক সংশোধনের প্রয়োজন। সংবিধানের ৮৩ এবং ১৭২ নম্বর অনুচ্ছেদে সংসদ এবং রাজ্য বিধানসভাগুলির মেয়াদ কতদিনের হবে, তা বলা আছে। বর্তমানে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে একই সঙ্গে নির্বাচন হয় তিনটি রাজ্যের – অন্ধ্র প্রদেশ, সিকিম এবং ওড়িশা। চলতি বছরের শেষের দিকে ভোট দেবে হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডও। এই বছরই, দীর্ঘ ছয় বছর পর বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে জম্মু ও কাশ্মীরেও। কাজেই এই রাজ্যগুলির নির্বাচনকে লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে সমন্বিত করাটা খুব অসুবিধার হবে না। কিন্তু, বাকি রাজ্যগুলির ভোট লোকসভা ভোটের বছরে হয় না। সেগুলিকে এক জায়গায় আনতে গেলে হয় কোনও কোনও রাজ্যের বিধানসভার মেয়াদ কমিয়ে অথবা বাড়িয়ে দিতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে বিষয়টা বোঝা যাক। ২০২৬ সালে এই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। ২০২৯-এ পরবর্তী লোকসভা নির্বাচন। কাজেই পশ্চিমবঙ্গের ভোটকে ২০২৯-এর লোকসভা ভোটের সঙ্গে একযোগে করতে হলে, ২০২৬-এ নির্বাচিত সরকারকে ২০২৯-এই ভেঙে দিতে হবে। নয়তো, ২০২১-এর নির্বাচিত সরকারকেই ২০২৯ পর্যন্ত বহাল রাখে হবে। এর জন্য সংসদের ওই দুই অনুচ্ছেদে বদল প্রয়োজন। উপরন্তু, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং বিরোধী দলগুলি ভারতের ফেডারেল কাঠামোর উপর এই ব্যবস্থার প্রভাব নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই ব্যবস্থা চালুর পর যদি লোকসভা বা কোনও বিধানসভার মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই বিলুপ্তি ঘটে, তাহলে সমস্ত নির্বাচনগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধনের ফের নতুন করে সব রাজ্যেই নির্বাচন করতে হবে। সমালোচকদের মতে এটা অবাস্তব।
এই প্রস্তাবের সমালোচকদের আরেকটি যুক্তি, যদি রাজ্যর এবং দেশের নির্বাচন একই সঙ্গে করা হয়, তাহলে জাতীয় উদ্বেগের বিষয়গুলির আড়ালে চলে যেতে পারে আঞ্চলিক সমস্যাগুলি। লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিত ভিন্ন ভিন্ন হয়। জাতীয় নির্বাচনে দেশের নিরাপত্তা, বিদেশ নীতি, আর্থিক নীতিগুলি বেশি গুরুত্ব পায়। অন্যদিকে, ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা থাকে। সেগুলি, প্রতিটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে উঠে আসে। তারই ভিত্তিতে ভোট দেন মানুষ।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে যেমন অত্যন্ত বড় ইস্যু হয়ে উঠেছিল দেশের নিরাপত্তা। দেশের মানুষ ভরসা রেখেছিলেন মোদীর নেতৃত্বের উপর। পশ্চিমবঙ্গেও মানুষও ঢেলে ভোট দিয়েছিলেন বিজেপিকে। কিন্তু, এর দুই বছর পর বিধানসভা নির্বাচনের সময় পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কিন্তু স্থানীয় সমস্যাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। জিততে পারেনি বিজেপি। যদি ২০১৯ সালেই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন হত, সেই ক্ষেত্রে মানুষ লোকসভার পাশাপাশি বিধানসভাতেও জাতীয় নিরাপত্তার খাতিরেই বিজেপিকে ভোট দিতে পারতেন। আঞ্চলিক সমস্যাগুলি হয়তো তাঁদের মনে ততটা প্রভাব ফেলত না।
এক দেশ এক নির্বাচন চালুর ক্ষেত্রে আর্থিক এবং সংস্থানগত বাধাও রয়েছে বলে মনে করেন সমালোচকরা। একসঙ্গে ভোট করতে গেলে বিপুল পরিমাণ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম প্রয়োজন। সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের খরচও অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গের মতো অনেক রাজ্যে ভোট পরিচালনার জন্য প্রচুর পরিমাণে কেন্দ্রীয় বাহিনীও দরকার হয়। সারা দেশে একসঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন পরিতালনা করতে গেলে কেন্দ্রীয় বাহিনীরও ঘাটতি হতে পারে।