নয়াদিল্লি: সমলিঙ্গ বিবাহ গোটা বিশ্বেই সাম্প্রতিক অতীতে এক বহু চর্চিত বিষয়। গত ২ দশকে একাধিক উন্নত দেশ সমলিঙ্গ বিবাহকে পুরোপুরি বা আংশিক ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভারতেও সমলিঙ্গ বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি উঠছে। স্বীকৃতি না থাকলেও, সাম্প্রতিক অতীতে দেশের বিভিন্ন শহরে সমলিঙ্গ দম্পতি বিয়ের ঘটনা সামনে এসেছে। সমলিঙ্গ বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টে একাধিক পিটিশন দায়ের হয়েছিল। সেই পিটিশনের শুনানির জন্য দেশের শীর্ষ আদালত পাঁচ বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ গঠন করেছে। প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন সেই বেঞ্চে শুরু হয়েছে এই মামলার শুনানি। সমলিঙ্গ বিবাহের বিষয়টির ‘মৌলিক গুরুত্ব’ রয়েছে বলে মত দেশের শীর্ষ আদালতের। এর আগেও সমকামী সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন রায় দিয়েছিল দেশের শীর্ষ আদালত। সমকামিতা অপরাধের তালিকা থেকে ২০১৮ সালে মুক্ত করেছিল দেশের শীর্ষ আদালত। সেই বেঞ্চে ছিলেন বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ও। কিন্তু সমলিঙ্গ বিবাহের স্বীকৃতি অধরা রয়ে গিয়েছে ‘এলজিবিটিকিউ’ (LGBTQ) অংশের মানুষের কাছে।
আদালতে চর্চা
হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট, স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্ট, ফরেন ম্যারেজ অ্যাক্টের মতো একাধিক বিবাহ সংক্রান্ত আইন রয়েছে দেশে। সেই আইনে সমলিঙ্গ বিবাহের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি নিয়েই শুনানি চলছে। এই বিষয়ের মৌলিক গুরুত্ব রয়েছে বলে বিষয়টি নিয়ে সবপক্ষের বক্তব্য শুনতে চায় সুপ্রিম কোর্ট। এই সংক্রান্ত রায় সমাজে প্রভাব ফেলবে বলেও মনে করে দেশের শীর্ষ আদালত। যদিও কেন্দ্র সমলিঙ্গ বিবাহে স্বীকৃতির জন্য শুনানির বিরোধিতা করেছে। স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্টের মধ্যেই এই বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আদালত জানিয়েছে, কোনও ব্যক্তির ব্যক্তিগত ধরন, যার ব্যাপারে অনেক ক্ষেত্রে তাঁর নিজেরও নিয়ন্ত্রণ নেই, তা নিয়ে ভেদাভেদ করতে পারে না এমনকি সমকামিতাকে শহুরে অভিজাত শ্রেণির বিষয় বলে আদালতে উল্লেখ করেছিল কেন্দ্র। সেই যুক্তি উড়িয়ে প্রধান বিচারপতি বলেছেন, “ব্যক্তির যে বিশেষত্বের উপরে ব্যক্তির কোনও হাত নেই, তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র কোনও বৈষম্য করতে পারে না। এই বিশেষত্বকে সহজাত হিসেবে দেখলে তাকে আর শহুরে অভিজাত বলা চলে না। এটা হয়তো শহুরে বলে মনে হচ্ছে কারণ সেখানে অনেক মানুষ লিঙ্গপরিচয় এবং যৌন রুচির আড়াল ঠেলে বাইরে আসছেন। বিষয়টা যে কেবল শহুরে বা অভিজাত শ্রেণির ব্যাপার, এমন কোনও পরিসংখ্যান সরকারের কাছে নেই।”
সরকারের মতামত
বিজেপির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার শুরু থেকেই সমকামী বিবাহের বিরোধিতা করেছে। সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছে কেন্দ্র। সেই হলফনামায় বলা হয়েছে, সমলিঙ্গ বিবাহ এবং অসমলিঙ্গ বিবাহের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে। তাই দুটোকে এক ভাবে দেখা উচিত নয়। আরও বলা হয়েছে, সমলিঙ্গ সম্পর্কের স্বীকৃতি পাওয়ার অর্থ এই নয় যে, সমলিঙ্গ বিবাহকে স্বীকৃতি দিতে হবে। অসমলিঙ্গ বিবাহের সামাজিক স্বীকৃতি রয়েছে বলে মনে করে কেন্দ্র। কেবল যৌনতা বা সম্পর্ক নয়, দেশ ও সমাজের উন্নতির জন্যই অসমলিঙ্গ বিয়ের স্বীকৃতি দরকার। সমলিঙ্গ বিবাহকে স্বীকৃতি দিলে দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও আদালতে যুক্তি দিয়েছে বিজেপির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের সরকার। এ বিষয়ে সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের মতামত নেওয়ার কথাও আদালতে জানিয়েছে কেন্দ্র। এ বিষয়টি নিয়ে আদালতে নয় আইনসভায় আলোচনার পক্ষেও সওয়াল করে কেন্দ্রীয় সরকার।
বিজেপির অবস্থান
সমকামিতার বিরোধিতা বিভিন্ন সময় করে এসেছে বিজেপি। অতীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমকামিতা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আদালতে মামলা হয়েছে বা আলোচনা হয়েছে। তখন এ বিষয়ের বিরোধিতা করেছে বিজেপির প্রথম সারির নেতারা। এমনকি দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে সৌরভ কিরপালের মনোনয়নও দেয়নি কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী তথা বিজেপি সাংসদ কিরেন রিজিজু এর বিরোধিতা করে সুর চড়িয়েছেন। সৌরভ কিরপাল হলে দেশের প্রথম ঘোষিত সমকামী বিচারপতি। সমকামিতাকে অপরাধের তালিকা থেকে সরানো যে দাবি উঠেছিল, তখনও তার বিরোধিতা করেছিল বিজেপি। যোগী আদিত্যনাথ, রাজনাথ সিংয়ের মতো নেতারা সমকামিতার বিরোধিতায় সরব হন।
আরএসএস-এর অবস্থান
সমকামিতা নিয়ে কেন্দ্রের অবস্থানকে সমর্থন করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস। গত মাসে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক দত্তত্রেয় হোসবলে এ বিষয়ে সঙ্ঘের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। সমলিঙ্গ বিবাহের বিরোধিতা করেছেন তিনি। এ ব্যাপারে বলেছেন, “বিবাহ হিন্দু ধর্মের সংস্কার, জীবন দর্শন। এটা কোনও চুক্তি বা আনন্দ উপভোগের মাধ্যম নয়। ব্যক্তিগত স্বার্থে সমকামিরা বিবাহ করতে পারেন না। বিবাহ কেবল নারী ও পুরুষের মধ্যেই হওয়া উচিত।” মুসলিম সংগঠন জমিয়ত উলেমা-ই-হিন্দ সমলিঙ্গ বিবাহ নিয়ে আপত্তির কথা জানিয়েছে। এ নিয়ে আদালতে একটি হলফনামা পেশ করেছে এই মুসলিম সংগঠন। সেখানে ওই সংগঠনের তরফে বলা হয়েছে, সমলিঙ্গ বিবাহ দেশের পরিবার ব্যবস্থার বিরোধী। তা ছাড়া এটি আইনি স্বীকৃতি পেলে বিভিন্ন ধর্মের ব্যক্তিগত আইনগুলি গুরুত্ব হারাবে।
ভারতে সমকামি সম্পর্ক অপরাধ না হলেও সমকামীদের বিবাহে স্বীকৃতি নেই। তা পাওয়ার জন্যই আদালতে চলছে শুনানি। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ইতিমধ্যেই সমলিঙ্গ বিবাহে স্বীকৃতি মিলেছে। তবে সেই তালিকায় উন্নত দেশগুলির ভিড় বেশি। গত ২ দশকে ৩০টিরও বেশি দেশে সমকামী বিবাহ স্বীকৃতি পেয়েছে।