কলকাতা: দিল্লি থেকে কলকাতা, ‘ওয়াকফ’ ইস্যুতে বিতর্ক চরমে। লোকসভায় শীতকালীন অধিবেশন শুরু হতেই সেই ইস্যু মাথাচাড়া দিয়েছে আবারও। এই অধিবেশনেই নতুন করে বিল পেশ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। তার আগে তৃণমূলের সাংসদরা দেখা করেন লোকসভার স্পিকারের সঙ্গে। এখানেই শেষ নয়, আগামী ৩০ নভেম্বর এই ইস্যুতে কলকাতার পথে নেমে সমাবেশ করবে তৃণমূল। তৃণমূলের মতোই বিরোধী দলগুলির দাবি, এই আইন কার্যকর করে সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব করতে চাইছে, তাদের সম্পত্তি কেড়ে নিতে চাইছে সরকার। আর সরকারের বক্তব্য, আদতে এই আইন লাগু করে সংবিধানকে স্বীকৃতি দিতে চায় তারা। এতে মহিলাদের অধিকারও সুরক্ষিত থাকবে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। আদতে কী এই ওয়াকফ? আইন বদলালে কী যায়-আসে?
তিন দশক পর বদলাচ্ছে আইন!
১৯৫৪ সালে সংসদে প্রথম ওয়াকফ আইন পাশ হয়েছিল। তখন ‘ওয়াকফ বোর্ডে’র হাতে এত বেশি ক্ষমতা ছিল না। পরে ১৯৯৫ সালে সেই আইন সংশোধন করে কংগ্রেস সরকার নতুন আইন আনে। তাতে ‘ওয়াকফ বোর্ড’কে কার্যত একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হয়। ভারতের বাইরে বিশ্বের আর কোনও দেশেই কোনও ধর্মীয় বোর্ডের হাতে এতখানি ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। মুসলিম অধ্যুষিত দেশ বা আরব দুনিয়াতেও এই নজির নেই। গত প্রায় ৩০ বছরে ১৯৯৫ সালের আইনে হাত পড়েনি কখনও। এবার সেই পুরনো ওয়াকফ আইনের খোলনোলচে বদলে নতুন আইন আনতে চলেছে কেন্দ্র।
কী এই ওয়াকফ সম্পত্তি?
কোনও ব্যক্তি, যিনি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী, তিনি চাইলে, তাঁর কোনও সম্পত্তি আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে দিতে পারেন। সেই সম্পত্তিকেই বলা হয় ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তি। ওয়াকফ সম্পত্তির মালিক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না, এমনটাই মনে করা হয়। তাই সেই সম্পত্তি বিক্রি করা বা হস্তান্তর করা যায় না। লিজেও দেওয়া যায় না। ওই সম্পত্তি সামাজিক কাজে অর্থাৎ শিক্ষা বা উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজে বা ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করা যায়।
১৯১৩ সালে অর্থাৎ ব্রিটিশ আমলে তৈরি করা হয়েছিল ওয়াকফ বোর্ড। এই বোর্ডই নিয়ন্ত্রণ করে ওয়াকফ সম্পত্তি। রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই এই সব সম্পত্তির ওপর।
ওয়াকফের ধারণা তৈরি হল কীভাবে?
ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, সুলতানদের শাসনের আমলে সুলতান মইজুদ্দিন সাম ঘোর দুটি গ্রাম উৎসর্গ করেছিলেন মুলতানের জামা মসজিদে। সেটাই ছিল প্রথম ওয়াকফ সম্পত্তি। পরবর্তীতে সুলতান আমলে ক্রমশ বাড়তে থাকে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যপ্তি। বর্তমানে দেশ জুড়ে বিপুল পরিমাণ ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে।
কত সম্পত্তি আছে ওয়াকফ বোর্ডের হাতে?
বর্তমানে ওয়াকফ বোর্ডের হাতে রয়েছে প্রায় ৯ লক্ষ ৫৪ হাজার একর জমি। সাড়ে ৮ লক্ষের বেশি বাড়ি-ঘরও রয়েছে। সব মিলিয়ে কম করেও দেড় লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ। কিন্তু এই সম্পদের উপর নেই কোনও ট্যাক্স। নেই কেন্দ্র কিংবা রাজ্য সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ। সবটাই ‘ওয়াকফ’ বোর্ডের হাতে।
ওয়াকফ বোর্ড যদি মনে করে, কোনও জমি বা বাড়ি তাঁদের সম্পত্তি, তা হলে তারা সেই জমি বা বাড়ির দখল নিতে পারে। ওই জমি বা বাড়ির মালিকানা প্রমাণ করারও দরকার নেই। ওয়াকফ বোর্ডের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে ভুরি ভুরি। তাই ওয়াকফ বোর্ডের হাতে থাকা এত সম্পত্তি, এত ক্ষমতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে।
ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে কেন এত বিতর্ক?
বিহারের গোবিন্দপুর গ্রাম। সেখানে ওয়াকফ বোর্ড দাবি করে, গোটা গ্রামটাই তাদের সম্পত্তি। অবাক হয়ে যান গ্রামবাসীরা। সেই মামলা গড়িয়েছিল আদালত পর্যন্ত। এটাই একমাত্র ঘটনা নয়। তামিলনাড়ুর থিরুচেন্দুরাই গ্রামে একটি ১৫০০ বছরের পুরনো মন্দির ও তার আশপাশের জমি নিজেদের বলে দাবি করে ওয়াকফ বোর্ড। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় ওয়াকফ সম্পত্তি অপব্যবহারের অভিযোগ উঠলেও সরকারের হাতে কোনও ক্ষমতাই থাকে না।
কতবার বদলেছে ওয়াকই আইন
১৯৫৪ সালে ওয়াকফ আইন পাশ হয়। সেই আইন অনুযায়ী ১৯৬৪ সালে ভারত সরকারের অধীনে তৈরি হয় একটি স্ট্যাটুটরি বডি। পরে ১৯৯৫ সালে ওয়াকফ আইনে বোর্ডের হাতে আরও বেশি ক্ষমতা যায়। ওয়াকফ কাউন্সিলের কাজ কী হবে, তার উল্লেখ ছিল এই আইনে। পরে ২০১৩ সালে ওয়াকফ ব্যবস্থা আরও স্বচ্ছ করতে কিছু সংশোধনী আনা হয়।
২০২৪-এর ‘ওয়াকফ’ সংশোধনী বিল কী? কেন আপত্তি?
২০২৪-এর ৮ অগস্ট ‘ওয়াকফ সংশোধনী বিল’ ও ‘মুসলিম ওয়াকফ বিল’ পেশ করা হয় লোকসভায়। সেখানে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশেষ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। সে ক্ষেত্রে বিরোধীদের অভিযোগ, ওয়াকফ সম্পত্তি অধিকার করার চেষ্টা করছে সরকার। আর সরকার পক্ষ বলছে, ওই সম্পত্তির যাতে কোনও অপব্যবহার না হয়, তার জন্য এই বিল পেশ করা হয়েছে।
কী কী বদল আনা হচ্ছে?
– নতুন বিলের সেকশনে ৩-এ বলা হয়েছে। কোনও ব্যক্তি, যিনি অন্তত ৫ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম পালন করছেন, তিনি যদি কোনও স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি ধর্মীয় বা উন্নয়নমূলক কাজে দান করে যেতে চান, তাহলে তা ওয়াকফ সম্পত্তি বলে গণ্য হবে।
– পুরনো আইনে বলা ছিল, যদি কেউ চান যে ওয়াকফ সম্পত্তি তাঁর পরিবারও ব্যবহার করতে পারবে, তাহলে সেই সম্পত্তিকে বলা হয় ‘ওয়াকফ আলাল অলাদ’। সংশোধন অনুযায়ী, সেই ‘ওয়াকফ আলাল অলাদ’ কেন্দ্রীয় সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী, বিধবা মহিলা, তালাক হওয়া বা বিবাহ বিচ্ছিন্না মহিলা ও অনাথ সন্তানের ভরনপোষণের কাজেও লাগানো যাবে।
– ওয়াকফ বোর্ডের হাতে যে সব ক্ষমতা ছিল, তার মধ্য়ে কিছু ক্ষমতা জেলার কালেক্টরের হাতে দেওয়া হয়েছে নতুন বিলে।
– নতুন বিলে বলা হয়েছে, জমির মালিক ছাড়া কেউ ওয়াকফ হিসেবে কোনও সম্পত্তি নথিভুক্ত করতে পারবেন না।
– ওয়াকফ আইন লাগু হওয়ার আগে পর্যন্ত যত ওয়াকফ সম্পত্তি নথিভুক্ত হবে বা হয়েছে, তার সব নথি একটি নির্দিষ্ট পোর্টালে জমা করতে হবে।
– কোনও সরকারি জমিকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে ঘোষণা করা হয়ে থাকলে, তা মানা হবে না।
– ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে কোনও বিতর্ক বা বিবাদ তৈরি হলে তাতে হস্তক্ষেপ করবেন কালেকটর। তিনি রিপোর্ট না জমা দেওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সম্পত্তিকে ওয়াকফ বলে ধার্য করা হবে না।
– কোনও সম্পত্তি ওয়াকফ হিসেবে নথিভুক্ত করার ৯০ দিন আগে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। কারও কোনও আপত্তি থাকলে, তা জানানো যাবে।
যৌথ কমিটি নিয়েও রয়েছে বিতর্ক
তবে এই বিল নিয়ে বিতর্ক থাকায় ঠিক হয়, যৌথ কমিটির কাছে পাঠানো হয় সেই বিল। অন্তত ২৫টি বৈঠকে বিল নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অভিযোগ, অনেকের কথা শোনা হলেও, গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারদের কথা শোনেনি ওই কমিটি। তাই কমিটির মেয়াদ যাতে বাড়ানো হয়, সেই আর্জি নিয়েই স্পিকারের কাছে গিয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদরা। স্পিকার মেয়াদ বাড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। সে ক্ষেত্রে এই শীতকালীন অধিবেশনে ওয়াকফ বিল পেশের সম্ভাবনা কম। অর্থাত্ বিল পেশ হতে পারে বাজেট অধিবেশনে।
সূত্রের খবর, ওয়াকফ বিল নিয়ে ৫০০ পাতার খসড়া রিপোর্ট প্রায় তৈরি। তাতে কী আছে, তা স্পষ্ট নয়। রিপোর্টে কোনও সংশোধনী ছাড়াই বিল ভোটাভুটির জন্য পাঠানোর সুপারিশ থাকছে। বিজেপি বিরোধীদের দাবি, দেশের সংখ্যালঘুদের অধিকার কেড়ে নিতে, তাঁদের আর্থিকভাবে ধাক্কা দিতে ওয়াকফ বিল আনছে কেন্দ্র। সংসদে এই ইস্যুতে একজোট সব বিরোধী দল।
কংগ্রেস, তৃণমূল, সমাজবাদী পার্টি, ডিএমকে, এমআইএম, জেএমএম, আপ সহ ১৬টি দল রয়েছে এই বিলের বিরুদ্ধে। তবে যৌথ কমিটিতে লোকসভার ২১ সদস্যের মধ্যে ৮ জন বিজেপির। একজন করে সাংসদ রয়েছে শিন্ডে-সেনা, জেডিইউ ও টিডিপি থেকে। তাই সংখ্যার হিসেবে সুবিধাজনক অবস্থায় বিজেপি। আপাতত সেই যৌথ কমিটি থেকে কী রিপোর্ট উঠে আসে সেটাই দেখার।