নয়াদিল্লি: ১৯৮৫ সালের ২৩ জুন। টরন্টো থেকে লন্ডন হয়ে মুম্বই যাচ্ছিল যাচ্ছিল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান। এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইট ১৮২। বিমানের ভাল নাম কণিষ্ক। ভ্যাঙ্কুভারে হল্ট করে লন্ডনের পথে রওনা হয়েছিল। গন্তব্যে পৌঁছনোর ৪৫ মিনিট আগে মাঝআকাশে বিস্ফোরণ। উত্তর আয়ারল্যান্ড উপকূলে রাডার থেকে হারিয়ে যায় কণিষ্ক। বিমানে ৩০৭ জন যাত্রী ও ২২ জন বিমানকর্মী ছিলেন। উত্তর আয়ারল্যান্ড উপকূলে সমুদ্রের উপর ভেঙে পড়ে বিমানটি। মাত্র ১৩১ জনের দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। একজনও প্রাণে বাঁচেননি। তদন্তে উঠে আসে, খালিস্তানপন্থীরাই বিমানে বোমা রেখেছিল। তদন্তকারীদের দাবি ছিল, যাত্রাপথে বিমানটি ভ্যাঙ্কুভারে থামে। আর সেই সময় একটি স্যুটকেসে বোমা রাখা হয়। আর তাতে বিস্ফোরণ ঘটেই মাঝআকাশে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বিমান। সেই সময় তো বটেও, এখনও পর্যন্ত ওই ঘটনা ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান নাশকতা। এর কয়েক বছর পর স্কটল্যান্ড উপকূলে একই কায়দায় লকার-বি বিমান নাশকতা দেখেছিল দুনিয়া। সেই ঘটনায় মিশরের তত্কালীন সর্বেসর্বা মুয়াম্মর গদ্দাফির হাত ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। কিন্তু কণিষ্ক নাকশকতার অভিঘাত ছিল অনেক, অনেক বেশি। কণিষ্ক নাশকতার প্ল্যানিং থেকে অনেক কিছুই হয়েছিল কানাডার মাটিতে বসে।
ঘটনায় মূল অভিযুক্ত হিসাবে যাদের নাম উঠেছিল, তারাও কানাডিয়ান। ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান। প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে রিপুদমন সিং মালিকের নাম উঠে আসে। রিপুদমন ছাড়াও ইন্দ্রর সিং বেয়াত ও আজাইব সিং বাগরি সহ আরও পাঁচ অভিযুক্তের নাম উঠে আসে। দুই দশক ধরে তদন্তের পর রায় দেয় কানাডার আদালত। এক অভিযুক্ত বাদে সবাইকে বেকসুর খালাস করা হয়। শুধু ইন্দরজিত সিং রেয়াতের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক কেনা ও পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। সেই অপরাধে ৩০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় ইন্দরজিতকে। কানাডার বিশেষ আদালতের বিচারক রায়ে বলেছিলেন, এতবড় একটা নাশকতার ঘটনায় পুলিশ কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি। তদন্তের রকমসকম দেখে মনে হচ্ছে, কণিষ্ক নাশকতা ঘটেইনি। কণিষ্ক স্রেফ মাঝ-আকাশে হারিয়ে গিয়েছে। ইন্টারপোলও কণিষ্ক নাশকতার রিপোর্টে বলেছিল, তদন্ত ঠিকমতো হয়নি। কানাডা সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছিল।
ঘটনায় কানাডা সরকারের বিরুদ্ধে সেদেশের সুপ্রিম কোর্ট থেকে রাষ্ট্রসংঘ – কোথাও কড়া নাড়তে বাকি রাখেননি মৃতদের পরিজনরা। কানাডা সরকার কোনও হেলদোল দেখায়নি। গত বছরের ১৪ জুলাই রিপুদমনকে নিজের দোকানের সামনে গুলি করে খুন করে দুই আততায়ী। হরদীপ নির্জ্জরের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভারত – কানাডা সম্পর্ক এখন তলানিতে। তেমন একটা সময়ে কণিষ্ক বিমান নাশকতার প্রসঙ্গ মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হল যে শুধু ইদানিংকালে নয়, গত তিন- চার দশক ধরেই পাক ও খালিস্তানি জঙ্গিদের দুধ-কলা দিয়ে পুষছে কানাডা। জাস্টিন ট্রুডোর বাবা, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো দুই ডজন খালিস্তানি নেতাকে কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিলেন। তখনই কানাডা থেকেই ভারতে খালিস্তানি নেটওয়ার্কের কাজকর্ম চলত। কানাডায় খালিস্তানিদের প্রভাব – প্রতিপত্তি বেশি। এদের হাত ধরেই ঢুকেছে পাক-পন্থী জঙ্গি সংগঠনগুলো। গত তিন বছরে চারজন বালুচ নেতা কানাডায় খুন হয়েছেন। স্বাধীন বালুচ আন্দোলনের অন্যতম মুখ ৩৯ বছরের করিমা বালুচকে প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করেছে দুষ্কৃতীরা। কানাডা তখন উচ্চবাচ্য করেনি। এখন নির্জ্জরের মতো এক দাগী জঙ্গির মৃত্যুতে হাত – পা ধুয়ে নেমে পড়েছে। কানাডা শুধুই অভিযোগ করেছে। কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি। আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সকেও ব্যবহার করার চেষ্টা করছে।
কানাডার সারেতে নির্জ্জরকে গুলি করে খুন করা হয়। সেই ঘটনায় ভারত যুক্ত এমন কোনও প্রমাণ নেই। নির্জ্জরের প্রসঙ্গে না গিয়েও একটাই কথা বলার। ভারতের নিজেকে সুরক্ষিত করার, নাগরিকদের সুরক্ষিত করার অধিকার আছে। সে নিয়ে কারও দাদাগিরি বরদাস্ত করার প্রয়োজন নেই। দরকারও নেই। গত ৭-৮ দিনে যা ঘটেছে, তাতে বিষয়টি আর ভারত-কানাডার মধ্যে আটকে নেই। ভারত ক্রমশই সুর চড়াচ্ছে। জানা গিয়েছে, কানাডা, আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো দেশে খালিস্তানপন্থীদের আইওসি তকমা বাতিল করা হবে খুব শীঘ্রই। খালিস্তানিদের ভারতে ঢোকা, সম্পত্তি কেনা বন্ধ হবে।
ভারত চাপ বাড়াতেই সুর কিছুটা নরম করেছেন কানাডার প্রতিরক্ষামন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, “আইনের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই আমরা। ভুল বোঝাবুঝি বা চাপানউতোর ছেড়ে আমাদের এগোতে হবে।”
সন্ত্রাসবাদীদের স্বর্গোদ্যান। এতদিন পাকিস্তান সম্পর্কে যে কথাটা বলা হত। এখন কানাডা সম্পর্কেও সেকথাই বলছে দিল্লি। বলা হবে নাই বা কেন। কানাডা ভারত-বিরোধী খালিস্তানি জঙ্গিদের হোমল্যান্ড হয়ে উঠলেও ওদেশের সরকার চুপ। কানাডার মাটি থেকে খালিস্তানিরা কানাডা ও ভারতে হিন্দু ও শিখদের মধ্যে বিভাজন ঘটাতে লাগাতার উস্কানি দিয়ে চলেছে। কানাডা সরকারের মুখে রা নেই। ভারত বারবার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও তারা হাত গুটিয়ে। আর এবার তো কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সরাসরি ভারত সরকারকে খুনির তকমা দিয়ে যাবতীয় কূটনৈতিক শিষ্টাচারকে গঙ্গাযাত্রায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাই খালিস্তানিদের প্রতি কানাডা সরকারের এতো দরদ কেন। এ প্রশ্নটা উঠছেই।