ঈপ্সা চ্যাটার্জী:
কয়েক দশকের অপেক্ষার পর ভারতে ফিরে এসেছে চিতা। গত ১৭ সেপ্টেম্বর, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিনেই আফ্রিকার নামিবিয়ার জঙ্গল থেকে ভারতে আসে আটটি চিতা। তাদের ছাড়া হয়েছে মধ্য প্রদেশের কুনো জাতীয় উদ্যানে। এটাই নতুন আস্তানা তাদের। কিন্তু বিদেশ থেকে কেন আনাতে হল চিতাদের? ভারতে কী কখনও চিতা ছিল না? কয়েক দশক আগেও ভারতে বাঘ-সিংহের পাশাপাশি চিতাও ছিল। কিন্ত ১৯২০ সালের পর থেকে ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে থাকে চিতা। ১৯৫২ সালে দেশ থেকে সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়ে যায় এশিয়াটিক চিতা। বর্তমানে বিশ্বের মধ্যে কেবল ইরানেই এশিয়াটিক চিতা রয়েছে, তাও আবার হাতে গোনা মাত্র ১২টি। এছাড়া আফ্রিকার চিতা রয়েছে, যার সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। নামিবিয়া থেকে আটটি আফ্রিকান চিতাই বর্তমানে আনা হল ভারতে।
ভারতে এই চিতা আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। প্রাথমিকভাবে এশিয়াটিক চিতা আনারই পরিকল্পনা ছিল, কারণ একই মহাদেশের মধ্যে থেকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করা হলে, চিতাদের পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সুবিধা হবে। শুধুমাত্র ইরানের কাছেই এই চিতা থাকায়, তাদের কাছেই আবেদন পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ইরান সেই আবেদন খারিজ করে দেয়, কারণ তাদের কাছেও মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি চিতাই রয়েছে।
শুধু ভারত থেকেই নয়, গোটা বিশ্ব থেকেই দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে চিতা। ১৯০০-র দশকেও চিতার সংখ্যা ছিল মাত্র ১ লক্ষ। সেই সময় বিভিন্ন প্রজাতির চিতা ছিল। কিন্তু অবাধ শিকার, খাদ্য সঙ্কট, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে অবলুপ্ত হতে থাকে চিতা। বর্তমানে মাত্র দুই প্রজাতির চিতাই রয়েছে- এশিয়াটিক ও আফ্রিকান। কিন্তু যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, জঙ্গল কমছে, তাতে ব্যাস্তানুপাতিক হারে চিতাদের সংখ্যাও ক্রমশ কমছে। এর সঙ্গে রোগ ও পরিবর্তিত আবহাওয়ার প্রভাবেও চিতাদের মৃত্যু হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের তথ্য অনুযায়ী, চিতাদের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হল আবহাওয়া পরিবর্তন ও তাদের প্রাকৃতিক বাসস্থান ধ্বংস। এর পাশাপাশি আরও একটি বড় কারণ হল অবাধ শিকার। চিতার প্রজনন হারও তুলনামূলকভাবে অনেকটাই কম হওয়ায়, তাদের সংখ্যা ক্রমশ কমছে। পরিবর্তিত আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতেও অভ্যস্ত নয় চিতা। বিশেষ করে চিতার শাবকদের লালন-পালন যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং হতে ওঠে।
ব্রিটিশ শাসনকালেই ভারত থেকে চিতা দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ ব্রিটিশ শাসকরা শিকার করতে ভালবাসতেন, তাদের মনোরঞ্জনের অন্যতম অংশ ছিল শিকার। বাঘ, সিংহ, হাতির পাশাপাশি চিতাও শিকার করা হত অবাধে। যারা চিতা শিকার করে আনত, তাদের জন্য থাকত মোটা টাকার পুরস্কার। ব্রিটিশ যুগে শিকারিদের চিতা শিকার করে আনার জন্য দেওয়া হত ৬ টাকা।
চিতার দ্রুত অবলুপ্তির অন্যতম আরেকটি কারণ হল, সহজেই পোষ মানানো সম্ভব। ব্রিটিশ যুগে চিতাদের পোষ মানানো হত কুকুরদের মতোই। বহু পুরনো ছবিতেই ব্রিটিশ শাসকদের পাশে গলায় চেইন বাধা চিতা দেখা যেত। অন্য প্রাণীদের শিকার করতে তাদের ব্যবহার করা হত। পশুর লড়াইয়েও ব্যবহার করা হত চিতাদের।
প্রায় এক যুগ বাদে ফিরিয়ে আনা হয়েছে চিতাদের। আগামী পাঁচ বছরে মোট ৫০টি চিতা ভারতে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। নামিবিয়া থেকে আসা চিতাগুলির এখনও অবধি কোনও সমস্যা না হলেও, আগামিদিনে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হতে পারে। এরমধ্যে অন্যতম হল খোলা জায়গা ও চিতাদের জন্য অবাধ শিকারের সুযোগ। তানজানিয়ার জঙ্গলে যেমন চিতারা সহজেই শিকার করে বেড়াতে পারে বা নিজের শিকারের কাছ থেকে পালিয়ে যেতে পারে, তা ভারতের জঙ্গলে সম্ভব নয়। কুনো জাতীয় উদ্যানের বনভূমিকে তৃণভূমিতে পরিণত করা হয়েছে। একাধিক জায়গায় পাথর থাকায় দ্রুতগতিতে ছোটা চিতাদের জন্য এটা বড় সমস্যা। এমনকী পাথরে ধাক্কা লেগে তাদের মৃত্যুও হতে পারে। এছাড়া অনেক সময় রণথম্বোর থেকে বাঘও এই জঙ্গলে চলে আসে। সেই বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
এছাড়া নামিবিয়া থেকে আনা চিতাদের অন্যতম সমস্যা হয়ে উঠতে পারে শিকার খোঁজা। যেখানে তারা আগে থাকত, সেখানে প্রায় ৫ লক্ষেরও বেশি হরিণ ছিল। কুনোয় যদি ব্ল্যাকবাক বা চিঙ্কারা হরিণ না হয়, তবে চিতাদের স্পটেড ডিয়ার শিকার করেই পেট ভরাতে হবে। এই হরিণগুলি সহজেই ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে পারে, ফলে চিতার শিকার খুঁজতে সমস্যা হতে পারে। পাশাপাশি হরিণগুলির বড় বড় শৃঙ্গ থাকায়, চিতাদের আহত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।