মুম্বই: সোমবার (৩১ জুলাই) ভোরে, জয়পুর-মুম্বই এক্সপ্রেসে ছড়িয়েছিল আতঙ্ক। নিরাপত্তার জন্য যে রেলওয়ে সুরক্ষা বাহিনীর দিকে তাকিয়ে থাকেন সাধারণ মানুষ, সেই বাহিনীরই এক কনস্টেবলের গুলিতে প্রাণ গিয়েছে তাঁরই এক ঊর্ধ্বতন কর্তা এবং তিন সাধারণ যাত্রীর। এই ঘটনার খবর পাওয়ার পর, সকলের মনে একটাই প্রশ্ন উঠেছে, কেন হঠাৎ এমন ভয়ঙ্কর কাজ করলেন আরপিএফ-এর এই কনস্টেবল? এই ঘটনা সম্পর্কে মুখ খুলেছেন আরপিএফ-এর আরেক কনস্টেবল ঘনশ্যাম আচার্য। ওই একই ট্রেনে যাত্রী সুরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ঠিক কী ঘটেছিল সোমবার ভোরের জয়পুর-মুম্বই এক্সপ্রেসে? ঘনশ্যাম জানিয়েছেন, ঘটনার কয়েক ঘন্টা আগে থেকেই অভিযুক্ত কনস্টেবল চেতন সিং অসুস্থ বোধ করছিলেন। তিনি ট্রেন থেকে নেমেও যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, এএসআই তাঁকে আরও দুই ঘণ্টা ডিউটি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমনিতেই, অল্পে রেগে যান চেতন। সময়ের আগে ছুটি না পেয়ে আরও খেপে গিয়েছিলেন এবং এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে দাবি করেছেন ঘনশ্যাম। গুলি চালানোর আগে তিনি নাকি এক সহকর্মীর গলাও টিপে ধরেছিলেন।
আরপিএফ কনস্টেবল ঘনশ্যাম আচার্য জানিয়েছেন, ওই দিন ট্রেনে গার্ড ডিউটিতে ছিলেন সহকারি সাব-ইন্সপেক্টর টিকারাম মিনা, কনস্টেবল চেতন সিং, কনস্টেবল নরেন্দ্র পারমার এবং তিনি নিজে। ভোর ২টো বেজে ৫৩ মিনিটে সুরাট থেকে তাঁরা ট্রেনে উঠেছিলেন। এএসআই টিকারাম মিনা এবং কনস্টেবল চেতন সিং ছিলেন এসি কামড়ায়, আর নরেন্দ্র পারমার এবং ঘনশ্যাম ছিলেন স্লিপার কোচে। যাত্রা শুরুর আধঘণ্টা পরই চেতন সিং জানিয়েছিলেন, তিনি অসুস্থ বোধ করছেন, নেমে য়েতে চান। এএসআই মিনা জানিয়েছিলেন, তাঁর আরও দু’ঘণ্টা ডিউটি বাকি আছে। কিন্তু, তা শুনতে চাননি চেতন। মুম্বই সেন্ট্রালের কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে কথা বলে এএসআই মিনা জানিয়েছিলেন, ডিউটি শেষ করার আগে চেতন ট্রেন থেকে নামতে পারবেন না। এতেই প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন চেতন শর্মা। এমনকি, এএসআই তাঁকে একটি কোল্ড ড্রিঙ্ক খাওয়াতে চেয়েছিলন, তিনি রাজি হননি।
এরপর, এএসআই-এর নির্দেশে চেতন শর্মাকে অন্য কোটে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়েছিলেন ঘনশ্যাম। তাঁর কাছ থেকে তাঁর রাইফেলটিও নিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু, ১০ মিনিট পরই উঠে বসে নিজের রাইফেলটি চান চেতন। ঘনশ্যাম দিতে রাজি না হলে, তাঁর গলা টিপে ধরেছিলেন চেতন। তাঁর হাত থেকে একটি রাইফেল কেড়ে নিয়ে সেখান থেকে চলে যান। ধস্তাধস্তির মধ্যে ভুল করে ঘনশ্যামের রাইফেলটি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন চেতন। অবিলম্বে এএসআই-কে তা জানিয়েছিলেন ঘনশ্যাম। এরপর, এএসআই মিনা এবং ঘনশ্যাম দুজন মিলে চেতন সিং-এর কাছে গিয়ে রাইফেল অদলবদলের বিষয়টি জানিয়েছিলেন। রেগে থাকলেও তিনি ঘনশ্যামকে তাঁর রাইফেল ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে, সেখান থেকে চলে আসার সময় চেতন শর্মা তাঁর রাইফেলের সেফটি ক্যাচ খুলতে দেখেছিলেন ঘনশ্যাম। বিষয়টি তিনি এএসআই মিনাকে জানান। মিনা সেই সময় ফের একবার চেনতকে মাথা ঠান্ডা করতে বলেছিলেন, বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন।
এরপর, ভোর ৫টা বেজে ২৫ মিনিট নাগাদ এক আরপিএফ কর্মী ঘনশ্যামকে ফোন করে জানিয়েছিলেন, এএসআই মিনাকে গুলি করেছে চেতন। শুনেই সেই কামড়ায় ছুটে গিয়েছিলেন ঘনশ্যাম। বহু যাত্রী উল্টো দিকে ছুটে পালাচ্ছিলেন। ঘনশ্যাম ফোনে খবর দিয়েছিলেন নরেন্দ্র পারমারকে, মুম্বই সেন্ট্রালের কন্ট্রোল রুমেও খবর দেন। তারপর গিয়েছিলেন চেতনের খোঁজে। বি১ কামড়ার কাছে তাঁকে দেখতে পেয়েছিলেন। ঘনশ্যাম দাবি করেছেন, হিংস্র মুখে তাঁর দিকে বন্দুক উঁচিয়ে ধরেছিলেন চেতন শর্মা। কাজেই সেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলেন তিনি। মিনিট দশেক পর কেউ একজন চেইন টেনে ট্রেন দাঁড় করিয়েছিল। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছিলেন চেতন সিং বন্দুক উঁচিয়ে এগিয়ে আসছেন। যাত্রীদের সব জানলা দরজা বন্ধ করে মাথা নীচু করে বসে থাকার নির্দেশ দিয়ে, ঘনশ্যাম আচার্য শৌচাগারে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এরপর তিনি গুলি চলার শব্দ পেয়েছিলেন। শৌচাগার থেকে বেরিয়ে এসে তিনি দেখেছিলেন বন্দুক হাতে রেল লাইন ধরে হাঁটাহাঁটি করছেন চেতন। ১৫ মিনিট পর, ফের মুম্বইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল ট্রেনটি। কামড়ার ফিরে এসে ঘনশ্যাম দেখেছিলেন তিন যাত্রী পড়ে আছেন, রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। বরিভালি স্টেশনে এএসআই মিনা-সহ হতাহতদের স্ট্রেচারে করে নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রেলপুলিশের কর্মীরা।
এদিকে, ট্রেন থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন অভিযুক্ত কনস্টেবল চেতন শর্মা। কিন্তু, অল্প সময়ের মধ্যেই ধরা পড়ে যান তিনি। মঙ্গলবার (১ অগস্ট) বরিভেলি কোর্টে তাঁকে পেশ করে আরপিএফ। ৭ অগস্ট পর্যন্ত তাঁকে হেফাজত নিয়েছে রেল সুরক্ষা বাহিনী।