ভোলবদলের আরব সাগরে চোখের নিমেষে তেজি ‘তাউটে’, কোন অঙ্কে?

তন্নিষ্ঠা ভাণ্ডারী | Edited By: সোমনাথ মিত্র

May 17, 2021 | 2:46 PM

কেন গুজরাটের উপকূলই লক্ষ্য 'তাউটে'র (Tauktae)? কেনই বা এত তেজ?

ভোলবদলের আরব সাগরে চোখের নিমেষে তেজি তাউটে, কোন অঙ্কে?
সাইক্লোনের গতিবিধি

Follow Us

কমলেশ চৌধুরী:

ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সমুদ্রের জলতলের তাপমাত্রা কত হতে হয়?

আবহবিদদের পর্যবেক্ষণ, অন্ততপক্ষে ২৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্তত ৫০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত ওই তাপমাত্রা থাকা প্রয়োজন।

এই মুহূর্তে আরব সাগরের সর্বত্র জলতলের তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে। অনেকটাই বেশি। আর এই ‘উষ্ণতা’র অঙ্কেই আরব সাগরে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রবণতা বাড়ছে। তাউটে নতুন সংযোজন মাত্র।

সাধারণ অঙ্কে আরব সাগরের চেয়ে বঙ্গোপসাগরে বেশি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। দুই সাগর মিলিয়ে বছরে গড়ে ৫টি ঘূর্ণিঝড় উদয় হওয়ার কথা। বঙ্গোপসাগরে ৪টি হলে, একটি আরব সাগরে। এর যুক্তি হিসেবে আবহাওয়া দফতরের দস্তাবেজে লেখা রয়েছে, বঙ্গোপসাগরে প্রশান্ত মহাসাগর থেকেও নিম্নচাপ সরে এসে শক্তি বাড়াতে পারে। আরব সাগরে সেই সম্ভাবনা নেই। সবই স্থানীয় সৃষ্টি। দ্বিতীয় যুক্তি, বঙ্গোপসাগরের চেয়ে তুলনায় ‘ঠান্ডা’ আরব সাগর।

কিন্তু ইদানীংকালে সেই প্রবণতায় পরিবর্তন।

২০১৯ সালে দুই সাগরে ৮টি ঘূর্ণিঝড় হাজির হয়েছিল। এর মধ্যে ৫টিই আরব সাগরে। ১৯০২ সালের পর সেই প্রথম। গত বছর পাঁচটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছিল দুই সাগরে। দু’টি আরব সাগরে। ঘটনা হল, এই সাতটির মধ্যে ৬টিই তীব্র বা তার চেয়েও বেশি শক্তিশালী। একটি আবার সুপার সাইক্লোন। ঘূর্ণিঝড় কিয়ার।

কেন এই পট-পরিবর্তন?

পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটেরোলজির জলবায়ু বিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথু কলের ব্যাখ্যা, ‘এতদিনের ধারণা ভেঙে দিয়েছে আরব সাগর। গত বেশ কয়েক বছর ধরেই উষ্ণ জলতলের ঝোঁক দেখা যাচ্ছে। এর ফলে ঘূর্ণিঝড় সংখ্যায় যেমন বাড়ছে, তীব্রতাও বাড়ছে। সমুদ্র যত বেশি উষ্ণ হবে, তত প্রবল বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাও বাড়বে।’ রক্সি একে জলবায়ু পরিবর্তনের ফল হিসেবেই দেখছেন।

দেখা যাচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়ের হুড়মুড়িয়ে তেজি হওয়ার ঘটনাও। শুক্রবার সকালের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছিল তাউটে, সোমবার সকালের মধ্যে আরও তিন দফায় শক্তি বাড়িয়ে চরম তীব্র হয়ে ওঠে। মৌসম ভবনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান, উপমহানির্দেশক সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘অল্প সময়ের মধ্যেই দ্রুত শক্তি বাড়ানোর ঘটনা ঘটছে। উষ্ণ সমুদ্র এর অন্যতম কারণ।’

আবহাওয়ার কোনও বিষয়ই একটি শর্তের উপর নির্ভরশীল নয়। আরও কয়েকটি অনুকূল পরিবেশ একসঙ্গে পেয়ে গিয়েছে তাউটে। বড়সড় সহায় ম্যাডেন জুলিয়ান অসিলেশন (এমজেও)। সহজ ভাষায় একে মেঘবাহী যাযাবর বলা যায়। পৃথিবীর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে সরে। যেখানে থাকে, সেখানে ঝড়-বৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দেয়। এই মুহূর্তে এমজেও-র অবস্থান তাউটে-র পক্ষে সহায়ক। সমুদ্রের জলতলের তাপমাত্রা বেশি থাকায় সমুদ্র থেকে তাপশক্তিও পাচ্ছে বেশি। ফলে আড়ে-বহরে বেড়ে ওঠার জন্য ‘জ্বালানি’র অভাব নেই একটুও।

সেই কারণে ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটারে পৌঁছনোর সতর্কবার্তাও দিয়েছে মৌসম ভবন। শেষমেশ তা সত্যি হলে গুজরাটের ইতিহাসে ভয়াবহতম ঝড় হবে তাউটে। শুধু তাই নয়, ২৩ বছর পর ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়বে গুজরাটে। ১৯৯৮ সালের পর এই প্রথম। এর আগে ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল বেশ কয়েক বছর। ২০০১ সালের ঘূর্ণিঝড় সমুদ্রে প্রবল প্রতাপশালী হলেও, স্থলভাগে ঢোকার আগে দুর্বল নিম্নচাপে পরিণত হয়। ২০১৯ সালেও দু’টি ঘূর্ণিঝড় বায়ু ও মহা ঢোকে গুজরাটে, তবে দুর্বল হয়ে। পরিসংখ্যান বলছে, গুজরাটে ঘূর্ণিঝড়ের আনাগোনা কম। গত ১৩০ বছরে এ পর্যন্ত মাত্র ২৪টি ঘূর্ণিঝড় সশক্তিতে বা দুর্বল হয়ে গুজরাটে ঢুকেছে। আসলে পূর্ব উপকূলের মতো পশ্চিম উপকূল ততটা ঘূর্ণিঝড়-প্রবণ নয়। বেশিরভাগ ঝড়-ঝঞ্ঝা ওমান, ইয়েমেন উপকূলের দিকে সরে যায়। বহু ঘূর্ণিঝড় আবার বিলীন হয়ে যায় মাঝ-সমুদ্রেই। কিয়ারই যেমন।

তবে এ বার গুজরাট কেন?

মৌসম ভবনের মহানির্দেশক মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্র বলেন, ‘পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে ঘূর্ণিঝড়ের উত্তর-পশ্চিম এগোনোর একটা ঝোঁক থাকে। কিন্তু আরও কয়েকটি বিষয় ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করে। এখন ভারত-ভূখণ্ডের উপর একটি বিপরীত ঘূর্ণাবর্ত রয়েছে, যা তাউটেকে ওমানের দিকে সরতে দিচ্ছে না। টেনে পশ্চিম উপকূলে ভিড়িয়ে দিচ্ছে।’

শুধু গুজরাট নয়, উপকূলের খুব কাছ দিয়ে এগোনোয় প্রভাব পড়েছে কেরল, কর্নাটক, গোয়ার উপকূলীয় এলাকাতেও। এবং আশঙ্কা, রাজস্থানেও প্রবল বৃষ্টি হতে পারে।

তাউটের এতই তেজ!

Next Article