Cyclone Mocha: চোখের নিমেষে ‘পিক-আপ’! দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে আমপানের চেয়েও ভয়াবহ ‘বাহুবলী’ মোখা
Cyclone Mocha Update: আমপানের চেয়ে বেশি শক্তি নিয়ে, মায়ানমার উপকূলে আছড়ে পড়বে মোখা। ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটারে বইতে পারে ঝড়। তার পরও সহসা শক্তি হারাবে না। উপকূল থেকে অন্তত ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি অটুট থাকার জোর সম্ভাবনা।
কমলেশ চৌধুরী:
চার চাকার পিক-আপ কেমন, গাড়িপ্রেমী মাত্রেই জানেন। এই যেমন হুন্ডাই ক্রেটা শূন্য থেকে একশোয় পৌঁছয় মাত্র ১০ সেকেন্ডে। হন্ডা সিটি বা রেনো ডাস্টারের লাগে ১১ সেকেন্ড। ফেরারি ৮১২ মডেলের জন্য আবার ২.৯ সেকেন্ডই যথেষ্ট। ঘূর্ণিঝড়ের দুনিয়াতেও পিক-আপ নিয়ে জোর টক্কর। যত দিন যাচ্ছে, দ্রুত শক্তি বাড়ানোর প্রবণতা বেড়েই চলেছে। মানে চোখের নিমেষে পিক-আপ। এই তালিকাতেই নবতম সংযোজন ‘মোখা’ (Cyclone Mocha)। ২৪ ঘণ্টায় সাধারণ ঘূর্ণিঝড় থেকে অতি তীব্র ঘূর্ণিঝড়, পরের ১৮ ঘণ্টায় একেবারে চরম তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয় মোখা। একটি তথ্য বলছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সাগরে ঝড়ের গতিবেগ বেড়েছে ৯০ কিলোমিটারেরও বেশি! যেন মুহূর্তের মধ্যে মামুলি থেকে বাহুবলী! সর্বশেষ আপডেটেও মৌসম ভবন জানিয়েছে, আজ দুপুরে মায়ানমার (Mayanmar) উপকূলে ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটারের ঝড় তুলে স্থলভাগে আছড়ে পড়বে মোখা।
মানে দ্বিশতাধিক! ঘূর্ণিঝড় না রোহিত শর্মার ব্যাটিং বোঝা মুশকিল। অথচ, বুধবার সকালে যখন ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ নিয়ে প্রথম পূর্বাভাস দেওয়া হয়, তখনও মোখা এমন শক্তিশালী হওয়ার আঁচ পাননি আবহবিদরা। শুরুতে বলা হয়েছিল, ল্যান্ডফলের সময় ঝড়ের সর্বোচ্চ গতিবেগ থাকতে পারে ১৩০ কিলোমিটারের আশপাশে। ধাপে ধাপে তা বাড়ানো হয়। পূর্বাভাস অনুযায়ী শনি-রাতে পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটার। চর্চা চলছে, তবে কি মোখাও আমপানের মতো সুপার সাইক্লোন হয়ে গেল? অনেক বিজ্ঞানীই মোখাকে ক্যাটাগরি ফাইভ হারিকেনের সঙ্গে তুলনা করা শুরু করে দিয়েছেন। মৌসম ভবন যদিও জানিয়েছে, মোখা চরম তীব্র ঘূর্ণিঝড় রূপেই উপকূলের দিকে এগোচ্ছে। এই রূপ অটুট রেখেই আছড়ে পড়বে স্থলভাগে। শেষবেলায় গতিবেগ কিছুটা কমতে পারে, এটাই যা রক্ষে।
যেমন খানিকটা কমেছিল ২০২০-র আমপানের ক্ষেত্রে। বাংলায় আছড়ে পড়ার আগে, সাগরে সুপার সাইক্লোনে পরিণত হয়েছিল আমপান। ১৯৯৯ সালের পর বঙ্গোপসাগরের প্রথম সুপার সাইক্লোন। বেশ কিছুক্ষণের জন্য ঝড়ের গতিবেগ ওঠে ঘণ্টায় ২৪০ কিলোমিটারে। পরে অবশ্য ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটার গতিবেগ নিয়ে বকখালিতে আছড়ে পড়ে আমপান। বাংলাকে তছনছ করে দেওয়া ঘূর্ণিঝড়ও সাগরে দ্রুত শক্তি বাড়িয়েছিল। চোখের নিমেষে পিক-আপ! মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঝড়ের গতিবেগ বেড়েছিল ১২০ কিমি/ঘণ্টা। কাছাকাছি আসবে ১০ বছর আগের ঘূর্ণিঝড় পিলিন। ২৪ ঘণ্টায় গতিবেগ বেড়েছিল ১১০ কিমি/ঘণ্টা। ২০১৭ সালের আরব সাগরের ঘূর্ণিঝড় অক্ষি বা ২০০৮ সালে মায়ানমারে আছড়ে পড়া ঘূর্ণিঝড় নার্গিসও চোখের পলকে শক্তি বাড়িয়ে নিয়েছিল। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৪ দফায় শক্তি বাড়ানো নার্গিসের ধাক্কায় ১ লক্ষ ৩৮ হাজার মানুষের প্রাণ গিয়েছিল মায়ানমারে। এ বার দুয়ারে মোখা। হাজির আরও বেশি শক্তি নিয়ে!
পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটেরোলজির জলবায়ু বিজ্ঞানী রক্সি ম্যাথু কল বলছেন, ”বঙ্গোপসাগরে পৃথিবীর মাত্র ৪% ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়, কিন্তু ৮০% মৃত্যুর জন্য দায়ী এই ঘূর্ণিঝড়গুলি। এর অন্যতম কারণ, দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি। ফলে সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে সময় কম পাওয়া যায়। সাধারণত ঝড়ের গতিবেগ ২৪ ঘণ্টায় ৫৫ কিমি/ঘণ্টা বাড়লেই আমরা র্যাপিড ইন্টেন্সিফিকেশনের তকমা দিই। এখন দেখা যাচ্ছে, এর দ্বিগুণ বা দ্বিগুণের বেশি শক্তিবৃদ্ধিও হয়ে যাচ্ছে।”
মোখা দ্রুত ‘বাহুবলী’ হয়ে উঠল কার ইন্ধনে?
মৌসম ভবনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ”ঘূর্ণিঝড় মোখার দ্রুত শক্তি বাড়ানোর পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ অবশ্যই বঙ্গোপসাগরের গরম জল। সাধারণত, ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির জন্য সমুদ্রের জলতলের তাপমাত্রা ২৬.৫ ডিগ্রি বা তার বেশি হতে হয়। জলতলের ৪ মিটার নীচে পর্যন্ত এই তাপমাত্রা থাকা জরুরি। মোখা যে পথে এগিয়েছে, সেই মধ্য বা পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগরে কোথাও কোথাও জলতলের তাপমাত্রা ৩১-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসও ছিল।” ঘূর্ণিঝড় সমুদ্রের জল থেকেই জ্বালানি খুঁজে নেয়। তাই মোখার ক্ষেত্রে সেই জ্বালানির বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয়নি। ঘটনা হল, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব জুড়েই তাপমাত্রা বাড়ছে। তার প্রভাব পড়ছে সমুদ্রের জলেও। যত গরম জল, তত তীব্র ঘূর্ণিঝড়, এই সমীকরণ পাকাপাকি হয়ে গেলে ভবিষ্যতে বিপদ বাড়বে বই কমবে না।
তবে মোখার দ্রুত শক্তি বাড়ানোর পিছনে অনুকূল আরও বেশ কয়েকটি কারণ। সঞ্জীববাবুর কথায়, ”বায়ুমণ্ডলের উপর ও নীচের স্তরের বায়ুপ্রবাহের গতির মধ্যে বিরাট পার্থক্য থাকলে ঘূর্ণিঝড় শক্তি বাড়াতে পারে না। কাঠামো ভেঙে গিয়ে দুর্বল হতে শুরু করে। একে আমরা বলি, ভার্টিক্যাল উইন্ড শিয়ার। মোখার ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরের ওই অঞ্চলে শিয়ার বেশ কম। তাছাড়া ভারত বা বাংলাদেশের স্থলভাগ থেকে অনেকটা দূরে থাকায় শুকনো, গরম হাওয়াও তেমন বেকায়দায় ফেলতে পারেনি।” মোদ্দা কথা, ঘূর্ণিঝড় দুর্বল হওয়ার মতো কোনও পরিস্থিতি হয়নি।
এখনও পর্যন্ত যা বোঝা যাচ্ছে, একমাত্র উপকূলের কাছে পৌঁছলেই, স্থলভাগের সঙ্গে ঘর্ষণে ঝড়ের গতিবেগ কিছুটা কমতে পারে। তাতেও আমপানের চেয়ে বেশি শক্তি নিয়ে, মায়ানমার উপকূলে আছড়ে পড়বে মোখা। ঘণ্টায় ২১০ কিলোমিটারে বইতে পারে ঝড়। তার পরও সহসা শক্তি হারাবে না। উপকূল থেকে অন্তত ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি অটুট থাকার জোর সম্ভাবনা। ফলে মায়ানমার তো বটেই, বাংলাদেশের কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামেও বড়সড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা। দিনভর প্রবল বৃষ্টিতে ধস বা সাময়িক প্লাবনের মতো পরিস্থিতি হতে পারে উত্তর-পূর্বের রাজ্যেও। বিশেষ করে ত্রিপুরা, মিজোরামে। সবচেয়ে বেশি ভয় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে। রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসেব, শুধু কক্সবাজারেই ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে থাকেন। পাশেই মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ, সেখানেও ৬ লক্ষ মানুষ ত্রাণের অপেক্ষায়। ক্যাম্প মানেই বাঁশ, ত্রিপলের অস্থায়ী কাঠামো। এমন ঝড়ের সামনে তা খড়কুটো মাত্র!
আরাকানের এই অঞ্চল থেকেই একসময় মগ দস্যুরা বেরিয়ে পড়ত। সেই ‘মগের মুলুক’ এ বার মোখা-দস্যুর সামনে। পরিণতি কি নার্গিসের চেয়েও খারাপ হবে?