তাঁর বাংলা উচ্চারণে মেঠো টান রয়েছে। মঞ্চে বক্তৃতা করতে উঠে কর্মীদের চাঙ্গা করতে সীমাও তিনিও বেশ কয়েকবার লঙ্ঘন করেছেন। ঘরোয়া আলোচনায় এ কথাও অকপটে স্বীকার করের রাজ্যের বিজেপি নেতারা। কিন্তু বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে যে চারাগাছের অবস্থায় ছিল, সেই চারাগাছকে বটবৃক্ষে পরিণত করার সিংহভাগ কৃতিত্বই যে দিলীপ ঘোষের (Dilip Ghosh) প্রাপ্য, তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। কিন্তু সব কিছুর মেয়াদই কখনও শেষ হয়, দিলীপের মেয়াদও ফুরিয়ে এসেছে। তাঁর জায়গায় নতুন রাজ্য সভাপতি হয়েছেন সুকান্ত মজুমদার। তবে বঙ্গ বিজেপির ইতিহাস লেখা হলে দিলীপের নাম যে প্রথম অনুচ্ছেদেই থাকবে, তা হলফ করে বলা যায়।
সালটা ২০১৫। এক বছর আগেই লোকসভা নির্বাচনে প্রথমবার রাজ্যে দু’টি আসনে জয়লাভ করেছে পদ্মশিবির। বছরখানেক পর, অর্থাৎ ২০১৬ সালেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। এমন একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে রাজ্য বিজেপির স্টিয়ারিং দিলীপ ঘোষের হাতে তুলে দিয়েছিলেন শীর্ষ নেতৃত্ব। দিলীপ তখন আরএসএস-র সক্রিয় কর্মী কেবল। তাঁর উপর ভরসা রাখার পর শুরুটা অবশ্য আশাব্যঞ্জক হয়নি বিজেপির। ২০১৬ সালের বিধানসভায় মাত্র ৩ টি আসন পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। সে যাত্রাতেও অবশ্য ব্যক্তিগত ক্যারিশ্মা দেখিয়ে খড়্গপুর সদরের আসন থেকে জয়লাভ করেছিলেন তিনি। তাঁর জনপ্রিয়তা তখন থেকেই বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। কিন্তু বিজেপি যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে যায়।
২০১৬ সালের ভোটের পরই দিলীপ বুঝতে পেরেছিলেন, প্রথাগত কায়দায় রাজনীতি করে তৃণমূলকে ঠেকানো সম্ভব হবে না। তাই আক্রমণের ধার বাড়িয়ে নিজেকে আরও বেশি আগ্রাসী করে তোলেন। শুরু হয়ে দিলীপের হুঙ্কার। রোজই কোনও না কোনও সভার মঞ্চ থেকে বিস্ফোরক মন্তব্য করে শিরোনামে উঠে আসতে শুরু করেন তিনি। তাঁর একাধিক মন্তব্য বিতর্কের সৃষ্টি করলেও দলীয় কর্মীরদের একাংশ এর দ্বারাই উৎসাহিত হন। যার ফল পঞ্চায়েত ভোটে হাতেনাতে পায় বিজেপি। লোকসভায় সুদে-আসলে লাভ উঠে আসে। ফল স্বরূপ, একবার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও পুনরায় রাজ্য সভাপতি মনোনীত হন দিলীপবাবু।
বিজেপির সাফল্যের সঙ্গেই অহরহ দিলীপের সঙ্গী হয়েছে বিতর্কও। গত ৬ বছরে এমন একটিও মাস সম্ভবত যায়নি, যেই মাসে বিতর্কিত কোনও মন্তব্যের জন্য সমালোচিত হননি দিলীপবাবু। দলের অন্দরে হোক বা বাইরে, কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও বা চুপিসাড়েই দিলীপের কু-কথার নিন্দা হয়েছে। কিন্তু দিলীপ নিজেকে বদলাননি। গরুর দুধে সোনা পাওয়ার মতো মন্তব্যে বিতর্কের ঝড় উঠলেও শেষ দিন পর্যন্ত অনড় থেকেছেন। জায়গায় জায়গায় শীতলকুচি হবে বলে কমিশনের নিষেধাজ্ঞাও সইতে হয়েছে। কিন্তু আগ্রাসন এতটুকু কমেনি। উল্টে সময়ের সঙ্গে যেন আরও ইস্পাত-কঠিন হয়েছেন তিনি।
তবে এমনটা নয় যে দিলীপ ঘোষ মানে শুধুই বিতর্ক, বা কেবলই কটূ কথার ফুলঝুড়ি। রাজনৈতিক গোলাগুলির বাইরেও তাঁর আড্ডাসুলভ ব্যক্তিতের ছোঁয়া যারা পেয়েছেন, তাঁরা মনে রেখেছেন। চা চক্র হোক বা খোশমেজাজে শরীরচর্চা করতে করতে গল্প-গুজব করা, দিলীপ ঘোষের সবটাই বাংলার দৈনন্দিন রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে থেকেছে। কখনও বিধানসভার সামনে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ের পর তাঁর মজাচ্ছলে করা মন্তব্য ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। একুশের ভোটযুদ্ধে ফলাফল যাই হোক না কেন, তিনি যে কঠিন প্রতিপক্ষ ছিলেন, তা একবাক্যে স্বীকার করেন তৃণমূলের একাংশের নেতারাও।
তাই দিলীপ ঘোষের অভাব শুধুই বঙ্গ বিজেপি টের পাবে এমনটা নয়। প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও তৃণমূলের নেতারাও হয়তো বিজেপি রাজ্য সভাপতি হিসেবে একজন রসবোধ সম্পন্ন, অথচ কঠিন প্রতিপক্ষকে মিস করবেন।