মাছের বাজারের বরফ নাকি মর্গের বরফ!

Aug 03, 2024 | 3:30 PM

Kolkata Fish Market: মাছের বাজারে গেলেই চোখে পড়ে ঝুড়ি বা ডাব্বা বা ট্রের মধ্যে বরফের উপর রাখা রয়েছে ইলিশ, রুই, কাতলা, চারা পাছ, চিংড়ি মাছ। বরফ দেওয়া মাছ মানেই স্টোরের মাছ বলে মনে করা হয়। কিন্তু সেই বরফগুলি কোথা থেকে আসে? হাসপাতালের মর্গে রাখা বরফ নয় তো? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় অনেকেরই মনে। সত্যিই কি মাছের বরফগুলি মর্গের স্টোর থেকে আনা হয়? নাকি অন্য কোথাও সেই বরফ তৈরি করা হয়? সেই বিশাল পরিমাণ বরফের জোগান কোথা থেকে আসে?

মাছের বাজারের বরফ নাকি মর্গের বরফ!

Follow Us

দীপ্তা দাস

বর্ষার আগমন হলেই শিশুমনে এক চমকিত পুলক জাগে। মাঠে, রাস্তায় বা বাড়ির ছাদে বৃষ্টিতে ভেজা এখন ভাবনার অতীত। অফিসফেরত বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে বাড়ি এলেই, পরের দিন প্যারাসিটামলের ডোজ নেওয়া অবধারিত। বাঙালি বড্ড নস্টালজিক। নিজের ছেলেবেলায় কাটানো বর্ষার দিনগুলি এখনও চোখের মধ্যে ভেসে ওঠে। স্কুল থেকে ফেরার পথে ভরা বর্ষায় পুকুর-খালবিল উপচে ওঠত। পুকুরের জল ওপরের দিকে উঠতেই পুকুরের মধ্যে থাকা মাছ, কাঁকড়া হঠাত রাস্তার মধ্যে চলাচল করতে শুরু করে দেয়। নালা-নর্দমা দিয়েও মাছ চলে যেত অন্যত্র। আর এই সুবর্ণ সুযোগ কখনও হাতছাড়া করতেন না অনেকেই। মাছ ধরতে রাস্তাতেই নেমে পড়তেন সকলে। তাতে স্কুল ফেরত ছাত্র থেকে রিক্সাওয়ালা, সকলে মিলে চলত মাছ ধরার প্রতিযোগিতা। সে এক আনন্দঘন মুহূর্ত। বাড়িতে এসে সেই মাছ ভেজে দেওয়ার আবদারও মায়েরা রাখতেন। রাতে খিচুরি আর মাছ ভাজা। তার যেমন স্বাদ, তেমনি গন্ধ। বৃষ্টি ভেজা দিনগুলিতে ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধও নাকে লেগে রয়েছে বাঙালির। গরম গরম ইলিশ মাছ ভাজার তেল দিয়েই একথালা ভাত উঠে যেত নিমেষের মধ্যে। রান্নাঘরে ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ পাওয়া মাত্রই থালা নিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে যেত বাড়ির সকলে। রাতেই হোক বা দুপুরে, ইলিশ মাছ বাড়িতে আসা মানে সেদিন প্রায় উত্‍সব লেগে থাকত। এখন নস্টালজিক ভাবনাতেই জীবিত ইলিশ মাছ ভাজা।

বর্তমানে ইলিশের দাম ও গন্ধ,উভয়েই দামি। তাতেও বাঙালির আশার কোনও শেষ নেই। তা সে সারাবছর অপেক্ষা করতে হলেও রাজি। গায়ের রঙ রুপোলি। কানকোর কাছে লালচে বা গোলাপি আভা। বাজারে গেলে কানকো টিপে মাছ না বাছতে পারলে সে বাঙালি নন। মিষ্টি জল থেকে সুন্দরী মাছকে তুলে আনা মাত্রই পাতে কখন পড়বে, সেই লোভ কোনও বাঙালি ছাড়তে নারাজ। কিন্তু যতই মরা বা সাইজে ছোট হোক না কেন,আমেরিকায় বসে থাকলেও ইলিশ মাছের সুস্বাদু স্বাদ জিভে লেগে থাকা চাই-ই চাই। বর্ষাকালে ইলিশমাছের ঝাঁক নদীর মোহনার দিকে চলে আসে। ডিম পাড়তে। আর সেটাই নাকি মোক্ষম সুযোগ। এই সুযোগ হাতছাড়া করলেই সারাবছরের লোকসান। টাটকা ইলিশ মাছের স্বাদ আলাদা। আবার বরফে দীর্ঘদিন ধরে রাখা ইলিশের স্বাদ আমার-আপনার সকলের জানা। ইলিশ মাছকে টাটকা বলে বিক্রি করা বিক্রেতাদের বিশ্বাস না করাই ভাল। কারণ ইলিশ মাছ কখনও টাটকা বিক্রি করা সম্ভব নয়। সাধারণত, নদীর মোহনা থেকে মাছ ধরার পড়ার সেটি যা কোল্ডস্টোরেজে। মানে মাছের আরতে। বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর সেটি বরফে প্যাকিং হয়ে চালান হয়ে যায় স্টোররুমে। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী দর হাঁকিয়ে দীর্ঘদিনের ইলিশ মাছ বিক্রি করা হয়।

বর্তমানে ইলিশ মাছ চেখে অনেকেই বলে দিতে পারেন, এই মাছ কতদিনের পুরনো। বরফের খাঁজে খাঁজে রেখে এই মাছ চলে যায় দূর-দূরান্তে। শুধু এই শৌখিন মাছ নয়,পুকুর, খাল-বিল থেকে তোলা রুই-কাতলা-কৈ-কাঁকড়া, সবই বরফের বাক্সে করে রওনা হয়ে যাচ্ছে দেশের কোণায় কোণায়। আকাশপথে উড়ে যায় বিদেশের মাটিতেও। তে এই মাছ সংরক্ষণ কতে গিয়ে যে বরফ ব্যবহার করা হয়, সেই বরফ কি মর্গে ব্যবহৃত বরফ? এই বিপুল পরিমাণে বরফের চাঁই আসে কোথা থেকে? এমন প্রশ্ন অনেকেরই। তাহলে মর্গে ব্যবহৃত বরফই বা আসে কোথা থেকে? জটিল প্রশ্নের ঘুরপাক খায় অধিকাংশের মনে। আগের একটি প্রতিবেদনে কলকাতার বুকে কীভাবে প্রথম বরফ এসেছিল, তার সংক্ষিপ্ত একটি ইতিহাস পরিবেশন করা হয়েছিল। বর্তমানে, কলকাতায় আর জাহাজে করে সুদূর আমেরিকা থেকে বরফ বয়ে নিয়ে আসে না। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কলকাতা ও শহরতলিতে কৃত্রিমভাবে বরফ তৈরি করা হয়। সেই বরফ শুধু মাছ সংরক্ষণের জন্যই নয়, নামি-দামি রেস্তোরাঁ বা পানশালায়, ফুলের আরতে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছেও সমান অপরিহার্য।

যখন-তখন গলায় ঠাণ্ডা পানীয় দিতে রাস্তার ধারে অনেকসময় ঘুমটির দোকানে উঁকিঝুঁকি দেওয়া হয়। বলা মাত্রই একটি সাদা থার্মোকলের বাক্স থেকে ঠাণ্ডা পানীয় বেরিয়ে আসে। এই বাক্সের মধ্যে থাকে বরফর কুঁচো। প্রচণ্ড গরমের সময় ঠাণ্ডা জলের জোগান দিতেও এই বরফকে কাজে লাগান তাঁরা। তবে এই বরফ কোথায় তৈরি হয়, কীভাবে তৈরি হয়, তা জানার প্রবল কৌতূহল রয়েছে। মাছ বা জিনিস ভেদে বরফের পরিমাণ কম-বেশি করা হয়। তবে মাছের আরতেই সবচেয়ে বেশি বরফের ব্যবহার। কয়েক ঘণ্টা থেকে ২-৩দিনের মধ্যে মাছ সংরক্ষণ করতে গেলেও মাছের ওজনের থেকে বেশি লাগে বরফ। গরমকালে মাছ জোগান দেওয়ার সময় মাছের বাক্সে মাছের থেকে সাদা কুচো বরফের পরিমাণ থাকে বেশি। এমকি বাজারে মাছ বিক্রি করার সময়ও মাছ বিক্রেতারা বরফ ঢেলে তার উপর মাছ রাখেন। যাতে দ্রুত পচন না ধরে। ইলিশ মাছ বিক্রি করার সময় বরফ ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক হয়ে গিয়েছে। বরফে রাখা মাছ যদি পচে যায়,তাহলে ধরে নিতে হবে বরফ সঠিক মাত্রায় রাখা হয়নি। মাছের তাপমাত্রা যাতে বাইে বেরিয়ে না আসে, তার জন্য সঠিকভাবে মেপে তারপর বরফ রাখা নিয়ম। বরফে দেওয়া মাছের তাপমাত্রা কোনওভাবে ৬-৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের উপরে না ওঠে। বাড়িতেও আপনি তাপমাত্রা মেপে প্যাকিং করতে পারেন।

এবার আসা যাক, মাছের বাজারে যে বরফ ব্যবহার করা হয়, তা মোটেও মর্গে ব্যবহৃত বরফ নয়। এটি একটি হুজুগে কথা। কৃত্রিমভাবে বরফ তৈরি হয় বরফের আরতে। আর বরফের আরত, মাছের আরতের কাছাকাছিই থাকে। সেখানে বিভিন্নভাবে বরফ তৈরি করা হয়। টিউব বরফ, সূক্ষ্ম পাতলা ফালির আকারে বরফ, ব্লক বরফ, চূর্ণ বরফ। সাধারণত মাছ সংরক্ষণ করতে ফালি করা বরফ ব্যবহার করা হয়। ব্লক বা চৌকো আকৃতির বরফও ব্যবহার করা হয়। অনেকেই ভেবে থাকেন, বরফ তৈরি জন্য যে কোনও জলই ব্যবহার করা যায়। তা একেবারেই নয়। পরিষ্কার দূষণমুক্ত জলই বরফ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। ক্লোরিনযুক্ত জল দিয়ে বরফ তৈরি করার রীতি। অনেকসময় খবরে উঠে আসে নানা চাঞ্চল্যকর ঘটনা। গরমকালে সরবতে মেশানো হয়েছে মাছের বাজারে ব্যবহৃত বরফ! কী কাণ্ড! এমন অভিযোগ উঠে বারবার। বরফের চাঁই পরিষ্কার কাঠের বাক্সে রেখে মোটা কাঠের টুকরো বা মুগুর দিয়ে তা ভেঙে ছোট ছোট টুকরো করা হয়। বরফের টুকরো হিসেবে যতটা দরকার ততটা ভেঙে নেওয়া হয়। সেই বরফের কুচিগুলি মাছের গায়ে গায়ে সমানভাবে রেখে দেন আরতের কর্মীরা। তবে এখানে সাবধানে থাকতে হয়। কারণ, বরফের কুচির ধারালো অংশ যদি মাছের গায়ে গভীরভাবে আঘাত লাগে, তাহলে সেই মাছে দ্রুত পচন ধরে। মাছ সংরক্ষণের প্রক্রিয়া মাছ ধরার সময় ট্রেলারেই করা হয়। তারপর আরে এসে সেই মাছ কিনে বাজারে চাহিদামতো বিক্রি করা হয়।

এবার আসা যাক, নৌকার ভিতরে কীভাবে বরফ রেখে মাছকে তাজা করে রাখা হয়। ট্রেলার বা বোটের ভিতর একটি আলাদা করে বরফের বাক্স থাকে। তবে বেশিরভাগ বোটে বা ট্রেলারের মধ্যে সাধারণত মাছের খোল থাকে। সেই খোল বা বাক্স তাপনিরোধী থাকে। স্থায়ী মাপের খোল বা ট্যাঙ্ক থাকায় সেখানে স্তূপাকারে মাছ সংরক্ষণ করা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। মাছ পরিবহণ করার সময় বরফ ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। অনেক ট্রাক রয়েছে, যেগুলিতে একটি স্থায়ী ট্যাঙ্ক করা থাকে, যেখানে মাঝ জ্যান্ত অবস্থায় পরিবহণ করা হয়। অন্যদিকে, বরফে মাছ সংরক্ষণ ও পরিবহণের জন্য লাগে এক হাত গভীর বরফের বাক্স। সেই বাস্ক প্লাস্টিক, থার্মোকলের বা কাঠের বাক্স আকারে থাকে। মাছের বাজারে গেলে দেখতে পাওয়া যায়, কমলা ও নীল রঙের প্রচুর প্লাস্টিকের বাক্স। প্লাস্টিকের বাক্স অপেক্ষাকৃত শক্ত ও দীর্ঘস্থায়ী হয়। এছাড়া সহজলোভ্য ও হালকা হয়ে থাকে। পরিষ্কার করা ও সংরক্ষণ করাও সহজ। তাই প্লাস্টিকের বাক্সে বরফের স্তূপের মধ্যে মাছ পরিবহণ করা সবচেয়ে সহজ ও খরচ কম। এছাড়া ভিতরে স্টিল বা অ্যালমিনিয়ামের পাতে মোড়া বাক্সও ব্যবহার করা হয়। কাঠের বাক্সেও বরফ রেখে মাছ সংরক্ষ করার পদ্ধতি চালু রয়েছে আরতে আরতে। তবে যারা আরও কম খরচে মাছ রাখতে চান, তারা বাঁশের ঝুরির মধ্যে ২ ভাঁজ করে পলিথিন রেখে, কলাপাতা দিয়ে ভালো করে মুড়িয়ে মুড়িয়ে মাছ রেখে দেন। সেটিও বেশ কিছুদিন তাজা রাখে। বরফে মাছ রাখার সময় মাথায় একটি জিনিস রাখতেই হবে। তা নাহলে মাছ বরফে রাখা সত্ত্বেও তা পচে যেতে পারে। ঝুড়ি বা বাক্স থেকে বরফ গলা জল বের করে দিতেই হবে। বরফে মাছ রাখার সময় নাকি মাছগুলিকে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা উচিত। বরফ আর মাছ গায়ে গায়ে লেগে থাকতে হবে। এমনভাবে সাজাতে হবে যে, দুটি মাছের মাঝখানে আধ ইঞ্চি করে বরফের কুচি দিয়ে স্তর থাকে। কোনও একটি মাছ অন্য মাছের গায়ে গায়ে লেগে না থাকে। মাছ একবার ঠাণ্ডা হয়ে গেলে পুনরায়আর মাছকে ঠাণ্ডা করার জন্য অতিরিক্ত বরফের দরকার পড়ে না। বরফ ও মাছ সঠিকভাবে রাখা হলে, বিদেশে গিয়েও তা পচে যায় না।

Next Article