কলকাতা: বাংলাদেশ জলসীমান্ত কি আদৌ সুরক্ষিত? ফাঁকফোকর দিয়ে যেসব বাংলাদেশি মৎস্যজীবী অনুপ্রবেশ করে, তারা কি আদৌ অনিচ্ছাকৃতভাবে এ কাজ করে থাকে? নাকি এগুলির পিছনে রয়েছে কোনও বড় পরিকল্পনা? উপকূলে চোরাকারবারের অছিলায় বড়সড় পরিকল্পনা করতেই পারে জঙ্গি সংগঠনগুলি। তাই নজরদারি আরও আঁটসাঁট করা প্রয়োজন বলেই মনে করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। সেকারণেই বঙ্গোপসাগরের প্রায় পুরোটা অংশ এবং বিশেষ করে বাংলাদেশ এবং ভারতের জল সীমান্ত গোটাটাই সুরক্ষিত নজর বলয়ের মধ্যে আনছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনস্থ উপকূল রক্ষী বাহিনীর আওতাধীন সামুদ্রিক উপকূলে নজরদারির জন্য গোটা দেশের উপকূলের অংশে তৈরি হচ্ছে আরও অতিরিক্ত ৩৬টি অত্যাধুনিক এবং ক্ষমতাশালী ক্যামেরা যুক্ত ও প্রযুক্তি সম্পূর্ণ সার্ভিল্যান্স রেডার স্টেশন। যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশায় নতুন ৪টি স্টেশন তৈরি হতে চলেছে। বঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফ্রেজারগঞ্জ এবং জুনপুটে তৈরি হচ্ছে এই রেডার স্টেশন।
মাঠে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি
অন্যদিকে ওড়িশায় তৈরি হচ্ছে চন্দ্রভাগা এবং আরখাখুড়াতে। উপকূল রক্ষী বাহিনীর উত্তর-পূর্ব আঞ্চলিক কমান্ডের মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশা। সেখানে আগে থেকেই রয়েছে মোট চারটি রেডার স্টেশন। তালিকায় সাগরদ্বীপ, হলদিয়া, পারাদ্বীপ, গোপালপুর। কিন্তু এই চারটি রেডার স্টেশন নজর দাড়ির জন্য পর্যাপ্ত নয় বলেই মনে করছেন উপকূলরক্ষী বাহিনীর শীর্ষকর্তারা। সেকারণে পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশা উপকর রক্ষী বাহিনীর আওতাধীন এলাকায় আরও রেডার স্টেশন তৈরির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন তাঁরা।
মঙ্গলবার উপকূল রক্ষী বাহিনীর হলদিয়ার হোভারক্র্যাফট রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্রে এক সাংবাদিক বৈঠকে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর উত্তর-পূর্ব আঞ্চলিক ইন্সপেক্টর জেনারেল ইকবাল সিং চৌহান বলেন, নজরদারি বৃদ্ধি করার যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কারণ ছোট থেকে ছোট জাহাজ অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। এমনকি, চোরাকারবারের বাড়বাড়ন্ত রক্ষাও আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ। সেকারণেই অত্যাধুনিক রেডার স্টেশন তৈরি করা হচ্ছে। চলতি বছরের আগস্ট মাসের মধ্যেই উপকূল রক্ষী বাহিনীর হাতে এই আধুনিক স্টেশনগুলি চলে আসবে।
জোরকদমে নজরদারি
উপকূল রক্ষী বাহিনী সূত্রে খবর, এই নতুন রেডার স্টেশন গুলিতে যে ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছে, তা অত্যন্ত আধুনিক এবং নিখুঁত তথ্য তুলে ধরতে পারবে কন্ট্রোলরুমে। এমনকি, কুয়াশাচ্ছন্ন বা প্রবল বৃষ্টিতেও সহজেই তথ্য হাতের কাছে পৌঁছে দেবে। বঙ্গোপসাগর এলাকায় ডর্নিয়ার বিমান এবং আধুনিক সশস্ত্র জাহাজ দিয়ে নজরদারি চালানো হয়। মৎস্যজীবীরা অনেক তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন। কিন্তু আধুনিক রেডার স্টেশন কাজ শুরু করলে অনেক না পাওয়া তথ্য হাতের নাগালে চলে আসবে বলে জানালেন উপকূল রক্ষী বাহিনীর ইন্সপেক্টর জেনারেল ইকবাল সিং চৌহান।
বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে নজরদারির জন্য উপকূল রক্ষী বাহিনী যে জাহাজ এবং বিমান ব্যবহার করে, সেগুলির ছাড়াও অন্যতম শক্তিশালী যান হচ্ছে ” হোভারক্রাফট”। বর্তমানে হলদিয়াতে যে যেটি রয়েছে সেখানে মোট চারটি এই হোভারক্রাফট রয়েছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন এই স্থল এবং জলযানে রয়েছে অত্যাধুনিক মেশিন গান। যেকোনো যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে দলে অথবা জলে নেমে তার মোকাবিলা করতে সক্ষম এই হোভারক্রাফট। তবে এখন এই চারটি হোভারক্রাফট দিয়ে নজরদারি হলেও, ভবিষ্যতের কথা ভেবে আরো যেটি তৈরি করা হচ্ছে নতুন এই স্থল ও জলযান নিয়ে আসার জন্য। হলদিয়ায় যে হোভারক্রাফট স্কোয়াড্রন রয়েছে, সেটির কমান্ডিং অফিসার কমান্ড্যান্ট অনিল যাদব বলেন, ফ্রেজারগঞ্জে যে ফরোয়ার্ড অপারেটিং বেস তৈরি করা হচ্ছে, সেটির কাজ শেষ হলে নতুন দু’টি আরো হোভারক্রাফট নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে সূত্রের খবর নতুন যে এই ঘাঁটি তৈরি হচ্ছে, সেটি সম্পূর্ণ সমরাস্ত্র রাখার জায়গা তৈরি হচ্ছে। কারণ শুধুমাত্র উপকূল রক্ষী বাহিনীর জন্য নয়, এই ফরোয়ার্ড অপারেটিং বেস আগামী দিন যে কোন সামরিক শক্তির কাজেও ব্যবহার হবে। এখনো পর্যন্ত ৪৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে এই ঘাঁটি সম্পূর্ণভাবে তৈরি হয়ে যাবে। যেটা উপকূল লক্ষ্মী বাহিনীর শক্তি আরও বাড়িয়ে দেবে বলেই মনে করছেন প্রতিরক্ষা বিশারদরা।
তবে শুধু যে রেডার স্টেশন তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিচ্ছে তা নয়, বাহিনীর জাহাজ তৈরির ক্ষেত্রেও প্রতিরক্ষা মন্ত্রক বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে। ইতিমধ্যেই মুম্বইয়ের মাজাগাঁও ডকশিপ বিল্ডার্স লিমিটেডের সঙ্গে এই চুক্তি করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। ভারতীয় উপকূলরক্ষী বাহিনীর ১৪টি দ্রুতগতি সম্পন্ন নজরদারি ভেসেলকে আরও আধুনিক সম্পন্ন করে তোলা হচ্ছে। একাধিক অত্যাধুনিক ফিচার্স আনা হবে এই ফাস্ট পেট্রলিং ভেসেলের সঙ্গে। মাল্টিপারপাস ড্রোন ব্যবহার করা হবে। দূর নিয়ন্ত্রিত ওয়াটার রেসকিউ ক্রাফট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করা হবে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উপকূল রক্ষী বাহিনীকে প্রযুক্তির দিক থেকে আরও উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বাহিনীর উত্তর-পূর্ব আঞ্চলিক ইন্সপেক্টর জেনারেল বলেন, আমরা নতুন যে জাহাজ এবং পেট্রলিং ভেসেল গুলি হাতে পাচ্ছি বা নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলিতে নয়া প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। যা শুধুমাত্র নজরদারি বৃদ্ধি বা চোরাকারবারীদের মোকাবিলা করতে সক্ষম তা নয়, সামুদ্রিক উপকূলে কেউ তথ্য চুরির চেষ্টা করলেও সেটিও ট্র্যাক করা যাবে।