কমলেশ চৌধুরী
এতদিন ‘১.৫ ডিগ্রি’ বা ‘২ ডিগ্রির চৌকাঠ’ পেরোনোর কথা উঠলে ২১০০ সাল বা ২০৮০ সালের কথা বলতেন রাষ্ট্রপুঞ্জের বিজ্ঞানীরা। বড়জোর ২০৫০ সালের কথা আসত। ঢের দেরি আছে ভেবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও চলত বিশ্ব জুড়ে। এখন দেখা যাচ্ছে, দুয়ারে দাঁড়িয়ে বিপর্যয়! রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা জানিয়ে দিয়েছে, সাময়িক ভাবে হলেও, ২০২৭ সালের মধ্যে প্রথমবার ‘১.৫ ডিগ্রির চৌকাঠ’ পেরিয়ে যাবে পৃথিবী। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নতুন ‘উষ্ণতম বছর’ও জুটবে বিশ্বের। গ্রিন হাউস গ্যাস, তার জেরে বিশ্ব উষ্ণায়ন– এসব তো আছেই, নতুন করে সলতে পাকানোর কাজটা করবে ‘এল নিনো’। আগামী মাসেই প্রশান্ত মহাসাগরে যার আবির্ভাব হয়ে যাওয়ার জোর আশঙ্কা।
কী এই ‘১.৫ ডিগ্রির চৌকাঠ’?
মোটামুটি ধরা হয়, শিল্পযুগ শুরুর পর থেকেই পৃথিবী ক্রমে উষ্ণ হয়ে উঠেছে। তাই তার আগের সময়ের তাপমাত্রাকে ভিত ধরে, বর্তমান সময়ের বাড়াবাড়ির আন্দাজ পাওয়ার চেষ্টা করেন বিজ্ঞানীরা। বাড়াবাড়ি যে হয়েই চলেছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আর তা ঠেকাতে নিয়মিত জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন এবং সেই সম্মেলনে লক্ষ্যমাত্রা বাঁধার কাজ চলে। যেমন, প্যারিস চুক্তিতেই বলা হয়েছিল, শিল্পযুগ-পূর্ববর্তী গড় তাপমাত্রার চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেড়ে গেলে বড়সড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া অনিবার্য। তাই যে ভাবেই হোক, গড় তাপমাত্রার বৃদ্ধিকে কোনও ভাবেই ‘১.৫ ডিগ্রির চৌকাঠ’ পেরোতে দেওয়া যাবে না। তার জন্য প্রতিটি দেশকেই গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমানোর শপথ নিতে হবে। এই ক’বছরে কাজের কাজ যে বিরাট কিছু হয়নি, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইডের মতো গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধিই তার প্রমাণ। প্রমাণ প্রতি বছরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির খতিয়ানেও।
যেমন, এখনও পর্যন্ত বিশ্বের উষ্ণতম বছর ধরা হয় ২০১৬ সালকে। সে বারই গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১.২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস উপরে পৌঁছে যায়। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার পূর্বাভাস, আগামী ৫ বছরের মধ্যে এই রেকর্ড ভেঙে যাবে। নতুন উষ্ণতম বছর পাবে পৃথিবী। সেই সঙ্গে বহুচর্চিত ‘১.৫ ডিগ্রির চৌকাঠ’ও পেরিয়ে যাবে বিশ্ব। তাপমাত্রার বৃদ্ধি ১.৮ ডিগ্রি পর্যন্তও হতে পারে। আবহাওয়া সংস্থার মহাসচিব পেত্তেরি তালাস শুধু সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন, ‘‘সাময়িক ভাবে পেরোবে। হয়তো এটাই পাকাপাকি হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে না।’’
তবে জিনিসের দাম একবার বাড়লে যেমন কমে না, ঠিক তেমনই তাপমাত্রা একবার বাড়তে শুরু করলে, আর তেমন কমে না। এতদিনের অভিজ্ঞতায় এই সারসত্যটুকু বুঝে গিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্বের প্রথম দশ উষ্ণতম বছরের প্রতিটি চলতি শতাব্দীর। সবচেয়ে বড় কথা, প্রশান্ত মহাসাগরে ‘লা নিনা’ থাকা সত্ত্বেও পঞ্চম বা ষষ্ঠ উষ্ণতম বছরের তকমা পেয়েছে ২০২২ সাল।
‘লা নিনা’ থাকলে কী লাভ হওয়ার কথা ছিল?
সার্বিক ভাবে পৃথিবীর উপর লা নিনা এবং এল নিনোর প্রভাব ঠিক উল্টো। লা নিনা পর্বে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব ভাগের জলতলের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ০.৫ ডিগ্রি নীচে নেমে যায়। তার প্রভাবে ‘ঠান্ডা’ হয় ধরিত্রী, এটাই নিয়ম। জ্বর এলে কপালে জলপট্টি দিলে যেমন তাপমাত্রা কমে, পৃথিবীর উপর লা নিনার প্রভাবও ঠিক তেমনই। অথচ ২০২০, ২০২১, ২০২২– পর পর তিন বছর বিরল ‘ট্রিপল ডিপ লা নিনা’ চললেও, ‘জলপট্টি’র তেমন কাজই হয়নি। ২০২২ সালেও গড় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে এক ডিগ্রি বেশি ছিল। স্পষ্ট করে বললে, ১.১৫ ডিগ্রি বেশি।
আর এ বার এল নিনো-র পালা। স্প্যানিশ শব্দের অর্থ বাংলায় করলে দাঁড়ায়, ‘ছোট মেয়ে’র জায়গায় ‘ছোট ছেলে’র দাপাদাপি শুরু হবে। এই দাপাদাপিতে ‘ক্ষতি’ বেশি। কারণ, এল নিনো পর্বে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাংশের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উপরে উঠে যায়। তার প্রভাব পড়ে বায়ুমণ্ডলে। গত মাসখানেক ধরেই জলতলের তাপমাত্রা বাড়ছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা সরাসরিই বলেছে, গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রভাব আছেই, এল নিনোর দাপটেও গরম বাড়বে। মোদ্দা কথা, ‘ডাবল ইঞ্জিন’-এর বিপদ। আর সেই কারণেই ২০২৭-এর মধ্যে দহন বাড়ার আশঙ্কা।
এর মানে বাড়বে খরা, বন্যা, তাপপ্রবাহের মতো চরম ঘটনাও। এপ্রিলে যে শুধু বাংলা-ওড়িশা তাপপ্রবাহে পুড়েছে, তা নয়। এপ্রিলে গরমের নতুন রেকর্ড গড়েছে স্পেন, পতুর্গাল, মরক্কো, আলজেরিয়াও। মে মাসে উষ্ণতায় টেক্কা দিয়েছে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, থাইল্যান্ড। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে একেবারে রাজস্থানের মতো গরম! এই মুহূর্তে জাপানেও যা তাপমাত্রা, তার সাক্ষী আগে কখনও হয়নি সে দেশের মানুষ। তাপপ্রবাহে পুড়ছে কানাডা। ফের গরমের রেকর্ড ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায়। দাবানলে জ্বলেই চলেছে অ্যালবার্তা।
অত্যধিক গরম মানেই বায়ুমণ্ডলে অস্থিরতা বাড়বে। কোথাও বন্যা বাড়বে। কোথাও খরা। আবার কোনও এলাকা খরার মধ্যেই বন্যার গ্রাসে পড়বে। সবচেয়ে আশঙ্কার, মেরুপ্রদেশের তাপমাত্রা তিন গুণ বাড়তে পারে। ফলে হিমবাহ গলবে। আর হিমবাহ গললেই, সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা বাড়বে। তাতে আরও বিপদ বাড়বে সুন্দরবনের মতো নিচু এলাকার। গত বছরের পাকিস্তানের ভয়াবহ বন্যার কথা মনে রয়েছে নিশ্চয়ই? প্রবল বৃষ্টি একমাত্র কারণ ছিল না। গ্রীষ্মে তাপপ্রবাহের দাপটে পাকিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলে হিমবাহ গলতে শুরু করেছিল। বর্ষায় বৃষ্টি আর হিমবাহ গলা জলই বিপদ ডেকে আনে। এখানেও সেই ডাবল ইঞ্জিনের শমন!
কতটা দুশ্চিন্তা বাড়ল রাষ্ট্রপুঞ্জের রিপোর্টে?
বম্বে আইআইটির অধ্যাপক গুড্ডু মুর্তুগুড্ডে বলছেন, ‘‘এটা ভাল যে ২১০০ সালের পূর্বাভাস না দিয়ে, সামনের দশকের কথা বলছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। এতে জলবায়ু পরিবর্তন যুঝতে সুবিধা হবে। তবে এই পূর্বাভাসে স্থানীয় ভাবে ঠিক কী ঘটতে পারে, তা বলা হয়নি। ফলে অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।’’ অসহনীয় গরমের জন্য অপেক্ষা করতে আদৌ ভাল লাগে কী!