কলকাতা: আমাদের পরিবারে যাঁরা গৃহবধূ রয়েছেন তাঁদের অনেককেই মাঝে মধ্যে শুনতে হয়, ‘বাড়িতে তো বসে থাকো…কাজ তো নেই…’ এই মত বা মানসিকতা একজন বা দু’জনের নয়। অনেকেই পোষণ করেন। কিন্তু আইন বলছে অন্য কথা। সত্যিই কি আইনের চোখে গৃহবধূর শ্রম পারিশ্রমিকের যোগ্য? সম্প্রতি, একটি মামলার রায় দিতে গিয়ে সেই আইনের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। মহিলাদের গৃহস্থলির কাজেরও পারিশ্রমিক রয়েছে। কোনও মহিলা অফিসে চাকরি বা ব্যবসা করে টাকা রোজগার না করলেও তিনি দিনের যত সময় বাড়ির কাজ করেন,তা পারিশ্রমিক বা বেতন যোগ্য। দুর্ঘটনাজনিত ক্ষতিপূরণ মামলায় রায়ে এমনই মত কলকাতা হাইকোর্টের। নিম্ন আদালতের দেওয়া ক্ষতিপূরণের নির্দেশ বহাল রেখেছে আদালত। এক্ষেত্রে হাইকোর্ট মনে করে দিয়েছে ২০০৮ সালে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের কথা। সর্বোচ্চ আদালত ব্যাখা করেছিল, যাঁরা বাড়িতে থাকেন তাঁদের বেকার বলে গণ্য করলে হবে না। প্রত্যেকদিন ১০০ টাকা করে ধার্য্য করতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন বর্ধমানের বাসিন্দা লুফতা বেগম। পরে মৃত্যু হয় তাঁর। ছেলে মীর শামিম আদালতের দ্বারস্থ হন। তাঁর অভিযোগ ছিল, মোটর অ্যাক্সিডেন্ট ক্লেম ট্রাইব্যুনাল থেকে ক্ষতিপূরণের যথেষ্ট অর্থ তাঁরা পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্ট বিমা সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করেন মৃতের ছেলে। কারণ যে গাড়িটির দ্বারা দুর্ঘটনা ঘটেছিল সেই গাড়িটির বিমা করা ছিল। এই মামলারই শুনানিতে বিচারপতি অজয় কুমার গুপ্তা ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া রায়ের উল্লেখ করেন। সেখানে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যাঁরা গৃহবধূ তাঁদের বেকার ভাবলে চলবে না। তাঁদের শ্রমের মূল্য তা গণ্য করতে হবে। এরপর হাইকোর্টে ওই বিমা সংস্থাকে ৪ লক্ষ ৫১ হাজার ৭০০ টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। মামলার শুনানিতে বিচারপতি অজয় কুমার গুপ্তার একক বেঞ্চ স্পষ্ট জানায়, ওই মহিলার ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্য টাকা অবিলম্বে তাঁকে দিতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সংস্থার আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বিচারপতি বলেন, “কোনও গৃহিণী মহিলার আয়কে আর পাঁচজন উপার্জনকারীর সঙ্গে তুলনা করা চলে না। কারণ তিনি শুধু উপার্জনই করেন না, গোটা সংসার এবং পরিবারকে আগলে রাখেন।” তাই তাঁর থেকে আয়ের নথি বা তথ্য জানতে চাওয়া অপ্রত্যাশিত বলেই মত আদালতের।
এ প্রসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিয়েছেন নিজের রায়ের কথা। তাঁর বক্তব্য আসলে গৃহবধূ সম্পর্কে এখনো মধ্যযুগীয় মানসিকতাই ধরে রাখা হয়। তিনি বলেছেন, “যে শ্রম দিয়ে থাকেন তাঁর মূল্য তাঁরা পাননা। এর বিরুদ্ধে মত পোষন করে আমি রায় দিয়েছিলাম। সুপ্রিম কোর্টও এখন সেই দিকেই ঝুঁকেছে। কিন্তু আমি বলব এই নিয়ে আইন করা উচিত। কারণ এই সকল মহিলারা পরিচারিকারদের থেকেও বেশি কাজ করেন। কারণ পরিচারিকারা অর্থের বিনিময়ে কিছুক্ষণ কাজের পর চলে যান। অথচ গৃহবধূরা সারাক্ষণ সংসার সামলান। তাঁদের এই কাজের যথার্থ মূল্য দেওয়া উচিৎ। আর তাঁদের এই কাজের যথার্থ মূল্য দিলে অর্থনৈতিক সুরক্ষাও তৈরি হয়। সামাজিক সাম্য তৈরি হয়।” আইনজীবী উদয় শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, “যেই মা বাড়িতে থাকেন তাঁর দাম অনেক বেশি। কারণ তাঁর সঙ্গে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যও জড়িত থাকেন। সেই কারণে সুপ্রিম কোর্টও বারেবারে বলেছে যাঁরা গৃহিণী তাঁদের বেকার বলা যাবে না।”