খোলা আকাশ চিড়ে চলে গিয়েছে ওভারহেড তার। তার সঙ্গে ঠেকে রয়েছে ট্রামের টিকি, অর্থাৎ, যে অংশটির মাধ্যমে ওভারহেড তার থেকে বিদ্যুৎ এসে প্রাণ দিত। কোথাও কোথাও ওভারহেড তারের কাটাকুটি। তার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে সে। আর তার উপর দিয়েই একে একে নাম আসে কলা-কুশলীদের। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘মহানগর’ সিনেমা। টাইটেল কার্ড দেখানোর পর, সুব্রত মিত্রর ক্যামেরা চলে আসে ট্রামের ভিতর। ফোকাস করে ট্রামের ভিতরে থাকা অনিল চ্যাটার্জির ক্লান্ত মুখের উপর। বড় শহরের নাগরিক জীবনের দৈনন্দিন নাটককে চিত্রিত করতে ট্রামকে ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ। আবার, তাঁরই পরিচালিত ‘অপুর সংসারে’ ট্রামেই সম্পাদকের চিঠি পড়েছিল অপু, হয়েছিল স্বপ্নপূরণ। শুধু কি সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’, মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘কালপুরুষ’ থেকে শুরু করে টলিউড ও বলিউডের অতি সাম্প্রতিক সিনেমাগুলিতেও বিভিন্ন অনুষঙ্গে এসেছে কলকাতার ট্রাম। সম্প্রতি, দেড়শোতম বছরে যাত্রা থেমেছে কলকাতার ট্রামের। তারপর থেকে কলকাতাবাসীর মনে বারে-বারে আসছে সেই সব দৃশ্য। নস্টালজিয়ার শহরে হাইপার-নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত মহানগরবাসী।
শুধু সিনেমাতেই কেন, অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসুদের কবিতায় বারবার এসেছে ট্রাম। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘রাস্তা চলেচে যত অজগর সাপ, পিঠে তার ট্রামগাড়ি পড়ে ধুপ্ ধাপ্।’ যে কবির মৃত্যু হয়েছিল ট্রাম লাইনে, সেই জীবনানন্দের লেখাতেও এসেছিল ট্রামের প্রসঙ্গ – ‘কয়েকটি আদিম সর্পিণীর সহোদরার মতো/ এই যে ট্রামের লাইন ছড়িয়ে আছে/ পায়ের তলে, সমস্ত শরীরের রক্তে বিষাক্ত বিষাদ স্পর্শ / অনুভব করে হাঁটছি আমি।’ কলকাতার বুক থেকে চিরতরে ট্রামকে তুলে দেওয়া নিয়ে, গত কয়েকদিনে নাগরিক সমাজে বিস্ময়, ক্ষোভ, বেদনা, নস্ট্যালজিয়ার মিশেলে এক অদ্ভুত অনুভূতির তরঙ্গ বইছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও ধরা পড়েছে এই ট্রাম নস্টালজিয়া – কেউ পোস্ট করছেন পুরোনো ছবি, কেউ ফিল্মের দৃশ্য, কেউ কবিতা বা গানের লাইন। অভিনেতা, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, চিত্রশিল্পী, সঙ্গীতশিল্পী – বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ কলকাতার ট্রাম নিয়ে তাঁদের আবেগ প্রকাশ করেছেন। এই এত আবেগের, এত নস্টালজিয়ার ট্রাম, ‘হেরিটেজ’-এর তকমা পাবে না? প্রশ্ন তুলেছেন ট্রাম গবেষক, তথা কলকাতা ট্রামকে ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমা দেওয়ার সোচ্চার সমর্থক, সৌভিক মুখোপাধ্যায়।
তিনি জানিয়েছেন, ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমা পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু মানদণ্ড রয়েছে। প্রথমত, যে গতিশীল বস্তুটির ঐতিহ্যের স্বীকৃতি চাওয়া হচ্ছে, সেটি কি এখনও সেভাবেই চালু রয়েছে? সেটি কি কখনও বন্ধ হয়েছিল? দ্বিতীয়ত, ওই গতিশীল বস্তু কি সেই এলাকার মানুষের কোনও কাজে লাগে? নাকি শুধুই বিনোদনের, আবেগের বিষয়?
ইতিহাস বলছে, কলকাতা ট্রাম পরিষেবা প্রথম চালু হয়েছিল ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। তবে শুরুতেই ধাক্কা খেয়েছিল। যাত্রী না হওয়ায় লাভ হচ্ছিল না। তাই, ১৮৮০-তে বন্ধ করে দেওয়া হয় পরিষেবা। সেই সময় অবশ্য ঘোড়ায় টানা ট্রাম ছিল। ট্রাম কোম্পানির হাতে ছিল ১৭৭ টি ট্রাম। সেগুলি টানার জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে ১০০০টি ওয়েলার ঘোড়া আনা হয়েছিল। তারপর অল্প সময় স্টিম ইঞ্জিনে চলতো ট্রাম। এরপর, ১৯০২ সালে আসে বৈদ্যুতিন ট্রাম। সৌভিক মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, খিদিরপুর থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত যে বৈদ্যুতিন ট্রাম লাইন চালু হয়, সেটাই ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম পরিষেবা। যা মাত্র কয়েকদিন আগে পর্যন্তও চালু ছিল। আর ট্রাম তো প্রথম থেকেই ছিল গণপরিবহনের মাধ্যম। সাধারণ মানুষ যাতে অল্প খরচে শহরের মধ্যে যাতায়াত করতে পারেন, সেই কথা ভেবেই ট্রাম পরিষেবা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন লর্ড কার্জন। বন্ধ হওয়ার আগে পর্যন্ত যাত্রীদের পরিষেবা দিয়ে গিয়েছে ট্রাম। কাজেই, ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তকমা পাওয়ার ক্ষেত্রে কলকাতা ট্রামের কোনও বাধা ছিল না।
যে কেউ আবেদন করলেই অবশ্য ইউনেস্কো সেই স্বীকৃতি দেয় না। এই বিষয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন সৌভিক। তারা জানিয়েছে, আবেদন করতে হয় সংশ্লিষ্ট কোনও সরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে। এই ক্ষেত্রে তা হতে পারত রাজ্য পরিবহণ দফতর। সৌভিকের আক্ষেপ, কোনও অজানা কারণে, এই বিষয়ে উদ্যোগ নেয়নি রাজ্য সরকার। তাই দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেলেও ব্রাত্য থেকে গিয়েছে কলকাতার আরেক আবেগ, ট্রাম।
তবে, শুধুই কি ঐতিহ্য-নস্টালজিয়া-আবেগের মধ্যে আটকে থাকবে ট্রাম? নাকি কলকাতার ভবিষ্যতও হতে পারত এই গণপরিবহণ? বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান বায়ুদূষণের মোকাবিলায় গোটা বিশ্ব ঝুঁকছে ইলেকট্রিক ভেহিকল বা বৈদ্যুতিন যানের দিকে। নিত্যনতুন বৈদ্যুতিন বাস, গাড়ি, মোটরবাইক, স্কুটার আসছে বাজারে। আর এই সময়েই বিশ্বের অন্যতম দক্ষ এবং পরিবেশবান্ধব গণপরিবহনের মাধ্যমকে আমরা বিদায় জানালাম। রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী অবশ্য জানিয়েছেন, এসপ্ল্যানেড থেকে ময়দান পর্যন্ত হেরিটেজ আকারে একটি সুসজ্জিত ট্রাম এরপরও চলবে। তবে তা নেহাতই ‘জয় রাইড’। কলকাতা প্রথম নয়, এর আগে মুম্বই, চেন্নাই এবং দিল্লিও বাতিল করেছিল ট্রাম। তবে, কলকাতার মতো কোনও শহরের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে তো জড়িয়ে ছিল না ট্রামের ঢং-ঢং শব্দ। শুধু ভারতীয় শহরগুলিই বা কেন, বিংশ গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকেই আমেরিকা-ইউরোপের শহরগুলি থেকেও এক-এক করে হারিয়ে গিয়েছিল ট্রাম পরিষেবা।
কিন্তু এখন, ঠিক উল্টো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত কয়েক দশক ধরে ফের বিভিন্ন শহরে ফিরে আসছে ট্রাম পরিষেবা। অনেক জায়গায় যেখানে ট্রাম পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, সেখানে ফের চালু হচ্ছে পরিষেবা। আবার কোথাও কোথাও একেবারে নতুন করে পাতা হচ্ছে ট্রামের লাইন। এই সকল শহরের কর্তৃপক্ষ বলছে, সাধারণত একটি রৈখিক করিডোর ধরেই যাত্রীদের সংখ্যা বেশি থাকে। এই ক্ষেত্রে বাসের থেকে অনেক বেশি কার্যকর ট্রাম। এছাড়া, ট্রামের যাত্রী ধারণক্ষমতা বাসের থেকে অনেক বেশি। কেউ কেউ মেট্রেরেলের পক্ষে সওয়াল করেন। কিন্তু, তার তুলনায় ট্রামের রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালনার খরচ অনেক কম। তাই ফিরছে ট্রামের সুদিন।
গত কয়েক দশকে নতুন করে ট্রাম চালু করেছে ফ্রান্সের স্ট্রাসবার্গ, প্যারিস, নিস, লিয়ঁ, ব্রেস্ট, গ্রেনোবল, ডিজন, মন্টপেলিয়ার, অ্যাভিগনন; স্পেনের বার্সেলোনা, মাদ্রিদ, জারগোজা, গ্রেনাদা, ভ্যালেন্সিয়া, বিলবাও; ইতালির ফ্লোরেন্স, বার্গামো, ক্যাগলিয়ারি, সাসারি; লুক্সেমবার্গ; নেদারল্যান্ডসের উট্রেখট; ডেনমার্কের আরহাস; সুইডেনের লুন্ড; পোল্যান্ডের ওলজটিন; গ্রিসের এথেন্স; পর্তুগালের আলমাদা; ফিনল্যান্ডের ট্যাম্পেরে; ব্রিটেনের নটিংহাম, লন্ডন, এডিনবার্গ; আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন; বেলজিয়ামের লিজ ইত্যাদি জায়গায়। প্রাগ, বার্লিন, মিউনিখ, উলম, হেলসিঙ্কি, ভিয়েনার মতো অনেক শহরে আবার ট্রাম নেটওয়ার্কের সম্প্রসারণ ঘটছে। শুধু ইউরোপে নয়, আমেরিকার পোর্টল্যান্ড, সিয়াটেল, শার্লট, ওয়াশিংটন ডিসি, সান দিয়েগো-সহ আরও কিছু শহরেও ট্রাম পরিষেবা চালু করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় ট্রামের ডেডিকেটেড লেন থাকলেও, অন্যান্য জায়গায় কলকাতার মতো শহরের কেন্দ্রস্থলে রাস্তায় উপর দিয়েই চলে ট্রাম। উন্নত ট্রাফিক পরিচালনা ব্যবস্থা থাকায় কোথাও যানজটের সমস্যা হয় না, দুর্ঘটনাও ঘটে না।
এই উন্নত দেশের শহরগুলিতে যখন ট্রাম ফিরছে, তখন কলকাতা কেন বিদায় জানাল ট্রামকে? আসলে সবথেকে বড় সমস্যা হল, কলকাতা ট্রামের কোনও আধুনিকিকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। অন্যান্য শহরে নিয়মিত ট্রামকে আধুনিক রূপ দেওয়া হয়েছে। কাজে লাগানো হয়েছে নতুন-নতুন প্রযুক্তি। নজর দেওয়া হয়েছে যাত্রী পরিষেবা উন্নত করায়। কিন্তু, কলকাতায় ট্রামগুলিকে একপ্রকার নিংরে নেওয়া হয়েছে। তারা, যতদিন পেরেছে পরিষেবা দিয়ে গিয়েছে। একেবারেই চলেনি যখন, তখন সেগুলিকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সৌভিক বলেছেন, “ঐতিহ্যের সঙ্গে তো আধুনিকিকরণের কোনও দ্বন্দ্ব নেই। আমরা তো বারবারই বলেছি ট্রাম পরিষেবাকে উন্নত করতে হবে। যাত্রী স্বাচ্ছন্দে জোর দিতে হবে। সেগুলি না করে, ধীরে ধীরে কলকাতার এই ঐতিহ্যকে শুকিয়ে মেরে ফেলা হল।”
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে, ‘ফিকি’ এবং ‘ইনস্টিটিউট অব আর্বান সাপোর্টে’র পক্ষ থেকে ‘মডার্ন ট্রামস ইন সিটিজ ইন ইন্ডিয়া’ বলে, একটি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, রাস্তার অন্যান্য যানবাহন চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে ট্রাম, এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই ভুল। আরও বলা হয়েছিল, কলকাতায় ট্রাম পরিষেবা চালু রাখা উচিত তো বটেই, সেই সঙ্গে পরিষেবাকে অবিরত আপগ্রেড করা উচিত। কলকাতার ট্রামকে চালু রাখার পাশাপাশি অন্যান্য ভারতীয় শহরেও আধুনিক ট্রাম পরিষেবা চালুর সুপারিশ করা হয়েছিল রিপোর্টে। রিপোর্টে আরও উঠে এসেছিল, মেট্রো রেলের ক্ষেত্রে সিগন্যালিং এবং ট্রেন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অপরিহার্য। ট্রামের ক্ষেত্রে তা লাগে না। মেট্রো রেলের তুলনায় ট্রাম তৈরি এবং পরিচালনার খরচও অনেক কম। অনেকে ইলেকট্রিক বাসের কথা বলেন। ক্যালকাটা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা জানিয়েছেন, একটা ইলেকট্রিক বাসের দামে অন্তত ৯ থেকে ১০টা পরিবেশবান্ধব ট্রাম তৈরি করা যায়। তাদের মতে, একটা ইলেকট্রিক বাসের ব্যাটারির দামেই অন্তত ৩-৪টে ট্রাম তৈরি করা যায়। এছাড়া, একটা ইলেকট্রিক বাসের আয়ু বড়জোড় ১০ বছর। সেখানে সামান্য রক্ষণাবেক্ষণের খরচেই একটা ট্রাম অন্তত ৪০ থেকে ৫০ বছর চলতে পারে। কাজেই, নস্টালজিয়া বা ঐতিহ্যের গন্ডিতে আটকে না থেকে, ট্রাম হতেই পারত কলকাতার ভবিষ্যৎ। কে বলতে পারে, অদূর ভবিষ্যতে আরও কোনও নতুন রূপে ফিরে আসবে না কলকাতায় সাধের ট্রাম?