একটা সময় কালীপুজোর পর ভোরের দিকে হালকা ঠান্ডা এই কলকাতা শহরেও দিব্যি টের পাওয়া যেত। আর গ্রামে গেলে তো রীতিমতো চাদর-সোয়েটার লাগত। সেই শীতের অনুভূতি অনেকদিন আগেই উধাও হয়ে গিয়েছে। বরং গরম থেকে আরও গরমের মধ্যে ঢুকে পড়ছে শহর। এই যে অক্টোবর চলে গেল, গতমাসটা ছিল দেশের ইতিহাসে ১২০ বছরের মধ্যে উষ্ণতম অক্টোবর। হাওয়া অফিস জানিয়ে দিয়েছে, নভেম্বরেও শীতের অনুভূতি মিলবে না। নভেম্বরে উত্তর-পশ্চিম ভারতের কিছু এলাকা বাদে দেশের বাকি সব জায়গায় তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকবে। সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ও সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা দুটোই বেশি থাকবে। মানে দিনে গরম তো লাগবেই, রাতেও রেহাই মিলবে না। ভারত না হয় গরমের দেশ। গরম শুধু এই দেশে নয়, অপেক্ষাকৃত ঠান্ডার দেশগুলোতেও থাবা বসিয়েছে।
জাপানের মাউন্ট ফুজির কথাই ধরা যাক। ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট কেরিঞ্চির পর এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম আগ্নেয়গিরি। হনসু দ্বীপের এই আগ্নেয় পাহাড় টোকিও থেকেও দেখা যায়। মাউন্ট ফুজি জাপানিদের কাছে খুব পছন্দের ঘুরতে যাওয়ার জায়গা। জাপানি সংস্কৃতির সঙ্গে জুড়ে আছে এই পাহাড়ের নাম। একটা সময় পাহাড়ের মাথায় বরফের ছবি তুলতেন পর্যটকরা। এবছর অক্টোবরে সেই দৃশ্য আর দেখা যায়নি। মাউন্ট ফুজির মাথায় বরফ দেখা গেল না। ১৩০ বছরের মধ্যে এই প্রথম অক্টোবর মাসে মাউন্ট ফুজিতে বরফ পড়ল না। আজ থেকে ৩০০ বছর আগে শেষবার বড় আকারে জেগে উঠেছিল এই সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। ১৩০ বছর আগে ছোট-খাটো ভলক্যানিক ইরাপশনের জন্য অক্টোবরে পাহাড়ের মাথায় বরফ জমেনি। এবার সেসবের বালাই নেই। তবুও, তুষার-শূন্যই থেকে গেল পাহাড়চুড়ো। জাপানের আবহাওয়া দফতর বলছে, জুন মাস থেকে তীব্র গরমে কাবু দেশ। জাপানের ওপর দিয়ে টানা বয়ে চলেছে গরম সামুদ্রিক বাতাস। তাই, চার হাজার মিটার উচ্চতাতেও বরফ জমতে পারছে না। বরফ না পড়ায় ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট মাউন্ট ফুজিতে এবছর দর্শকদের ভিড় নেই। ওই এলাকায় যাওয়ার জন্য পর্যটকদের কাছ থেকে বিশেষ ফি নেয় জাপান সরকার। এ খাতেও আয় প্রায় বন্ধ। সব মিলিয়ে গরম ঘুম কেড়েছে জাপানের।
দেশে দেশে একই অবস্থা। বরফ যেমন পড়ছে না, নদীও তেমন শুকিয়ে যাচ্ছে। ছোট কোনও নদী নয়, আমাজনেরও একই অবস্থা। শুনে অবাক লাগছে তো। অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। শুকিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের বৃহত্তম নদী আমাজন।
আমাজন। তার বিশালতার জন্য নামটা শুনলেই কেমন যেন একটা রহস্য আর সম্ভ্রমে ভরে যায় মন। যে আমাজনের বৃষ্টি অরণ্য পৃথিবীর ফুসফুস। যে আমাজন জলপ্রবাহের হিসাবে দুনিয়ার বৃহত্তম নদী। সেই আমাজনেই আজ জলের অভাব। একদিকে দাবানলে মাইলের পর মাইল ন্যাড়া হয়ে যাচ্ছে রেন ফরেস্ট। আর অন্যদিকে খরায় শুকিয়ে যাচ্ছে নদী। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের হাত থেকে আমাজনও নিজেকে বাঁচাতে পারছে না। আমাজনের অন্যতম বড় উপনদী সোলিমাস এখন মৃতপ্রায়। অধিকাংশ জায়গায় জলের গভীরতা সর্বাধিক ১০ ফুটে নেমে এসেছে। আর বাকিটায় নদীর বুকে জলই নেই। শুধুই বালির চড়া।
পেরুর আন্দিজ পর্বতমালা থেকে সোলিমাসের জন্ম। ব্রাজিলের বন্দর শহর মানাউসের কাছে সে এসে মিশেছে আমাজনে। দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার। সোলিমাস মরণাপন্ন হয়ে যাওয়ায় ব্রাজিল ও পেরুর বিস্তীর্ণ এলাকার অর্থনীতিতে নেমে এসেছে সঙ্কট। সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছেন মানাউস সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দারা। নদী আর স্টিমার কিংবা নৌকো চলাচলের যোগ্য নয়। ফলে, জলপথে খাবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন জরুরি জিনিস আসার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। বিস্তীর্ণ এলাকায় তৈরি হয়েছে পানীয় জলের সমস্যা। নদীর আশপাশের গ্রামগুলো বাকি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মাছ ধরে যাঁরা পেট চালাতেন তাঁদের এখন খালি পেটেই দিন কাটছে। আর নদীকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বাস্তুতন্ত্র, নদীর ওপর নির্ভরশীল জীবজগত, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সব।
পরিবেশবিদরা বলছেন, সামনের বর্ষাতেও যদি জল না আসে তাহলে হয়ত চিরতরে হারিয়েই যাবে সোলিমাস। মৃত্যু হবে একটা নদীর। আর তার সঙ্গে এই নীল গ্রহ ধ্বংসের পথে আরেকটা ধাপ এগিয়ে যাবে।