কলকাতা: সম্প্রতি বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। পুলিশি তদন্তে জানা গিয়েছে এই সব অপরাধের মাস্টার মাইন্ড একজন। বিহারের কুখ্যাত বেউর জেলে বসেই সে সবটা অপারেট করছে। নাম তাঁর সুবোধ সিং। ডাকাত দলের পাণ্ডাও বলা যেতে পারে। কিন্তু শুধু কী ডাকাতি? নাকি আরও অনেক কিছু আছে সুবোধের নেটওয়ার্কে? পুলিশ তদন্ত করছে। একটু নেড়ে ঘেঁটে দেখতেই আমাদের হাতেও এমন কিছু তথ্য ও সূত্র উঠে আসছে যা চমকে দেওয়ার মতো। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, বাংলার অপরাধ মানচিত্র কী বিহার থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে? কেন এই আশঙ্কা?
কলকাতা লাগাোয়া ব্যারাকপুর অঞ্চলের এক ব্যবসায়ীর গাড়ি ঘিরে চলল গুলি। তারপরের দিন হুমকি ফোন। মারা হয়নি, বাঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে। চাইলে নাকি শোরুমে ঢুকে ৫০ রাউন্ড গুলি করা হত। কোনও রাগ ঢাক নেই। প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে এক গ্যাংস্টার। নাম সুবোধ সিং। বিহারের বেউর জেলে বন্দি সে। কিন্তু বন্দি তো নামেই। জেলে বসেই দেশের সাত সাতটি রাজ্যে অপরাধের সাম্রাজ্য চালাচ্ছে সে। সাত রাজ্যের মধ্যে একটা আমাদের বাংলাও। সূত্রের খবর, গত কয়েক মাস ধরে নয়, অনেক দিন থেকেই আমাদের রাজ্যে অপরাধের নেটওয়ার্ক পাকাপোক্ত করেছে সুবোধ সিং।
বাংলায় দুষ্কর্মে বিহার-যোগ
অক্টোবর, ২০২০: বিজেপি নেতা মনীশ শুক্লা খুন, পাকড়াও বিহারের শার্পশুটার
মার্চ, ২০২২: পানিহাটির তৃণমূল কাউন্সিলর অনুপম দত্ত খুনে বিহারের দুষ্কৃতী গ্রেফতার
এপ্রিল ২০২৩: বিজেপি নেতা রাজু ঝা খুন, বিহার থেকে পাকড়াও অভিযুক্ত
মে, ২০২৩: ব্যারাকপুরে সোনার দোকানে ডাকাতি-খুন, দুষ্কৃতীরা বিহারের
অগাস্ট, ২০২৩: পুরুলিয়ায় সোনার দোকানে ডাকাতি, দুষ্কৃতীরা বিহারের
অগাস্ট, ২০২৩: নদিয়ার রানাঘাটে সোনার দোকানে ডাকাতি, দুষ্কৃতীরা বিহারের
জুন, ২০২৪: রানিগঞ্জের সোনার দোকানে ডাকাতি, দুষ্কৃতীরা বিহারের
ওয়াকিবহাল মহলের ধারনা, গত কয়েক বছরে একের পর এক অপরাধের ঘটনা যে এক সূত্রে গাঁথা যেতে পারে সেটা তদন্তকারীরা আগে বুঝতে পারেননি। কিন্তু তদন্ত যত এগিয়েছে ততই তাজ্জব বনে গিয়েছেন তদন্তকারীরা। এই সব কিছুর পেছনে যে একটা মাথা কাজ করছে তা শুরুতে বোঝা যায়নি। একের পর এক ঘটনা ঘটেছে। আলাদা আলাদা তদন্ত শুরু হয়েছে। কিন্তু সব তদন্তে একটা কমন ফ্যাক্টর কাজ করেছে। অপরাধের বিহার যোগ। আর মাথা পাটনার বেউর জেলে বন্দি সুবোধ সিং।
বিজেপি নেতা মণীশ শুক্লা খুনের তদন্তে উঠে আসে সোনা ডাকাতি গ্যাংয়ের যোগ। যে শার্প শুটার ব্যবহার করা হয়েছিল এই খুনে তাদের গ্রেফতার করা হয় লুধিয়ানা থেকে। মণীশ শুক্লাকে খুনের পর তারা বিহার, উত্তর প্রদেশ হয়ে লুধিয়ানা পৌঁছায়। সেখানে তাদের পরের টার্গেট ছিল সোনার দোকানে ডাকাতি। সেই ডাকাতির সময়ই গ্রেফতার হয় তারা। পাশাপাশি তদন্তে তামিলনাড়ু থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল আরেক শার্প শুটারকে। যে তালিমনাড়ুতে সোনার দোকানে ডাকাতির ঘটনায় সে রাজ্যের পুলিশের হাতে ধরে পরে।
জেলে বসেই সবটা পরিচালনা
সূত্রের খবর, বাংলার বিভিন্ন জেলে বন্দি বিহারের অপরাধীদের বেছে বেছে ব্যবহার করছে সুবোধ সিং। কী ভাবে সুবোধের ওপর নিয়ন্ত্রণ পাওয়া যাবে, চিন্তায় বাংলার পাশাপাশি একাধিক রাজ্যের পুলিশ। সোনার ডাকাত সুবোধ সব ধরনের অপরাধে হাত পাকিয়ে বিরাট সাম্রজ্য তৈরি করেছে। এবং সেই সাম্রাজ্যের খুঁটিনাটি সব খবর থাকে তার কাছে। কেউ বেইমানি করলে তাকে যেমন শাস্তি দেয় সুবোধ, তেমনই নিজের সব সৈনিকের মাথার ওপর তার হাতও থাকে। অপরাধ জগতের মশিহা হয়ে উঠেছে সে। বেউর জেলে বসেই সবটা পরিচালনা করছে সুবোধ সিং।
মণীশ শুক্লা খুন, রাজু ঝাঁ খুন, একের পর এক সোনার দোকানে ডাকাতি। ব্যারাকপুর অঞ্চলে বিরিয়ানির দোকানে গুলি চালানো। টিটাগড় অঞ্চলে ব্যবসায়ীদের থেকে তোলাবাজি, গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি, ফোনে হুমকি। সবেতেই সুবোধ যোগ। তদন্ত এর আগেও অনেক হয়েছে। কিন্তু কোনও রাজ্যের পুলিশই সুবোধ ও তার গ্যাংকে আটকাতে পারেনি। বাংলার পুলিশ বাড়তি উদ্যোগ নিয়েছে বলেই খবর। বাংলা থেকে সুবোধের অপরাধের শিকড় উপড়ে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে জোরকদমে। সুবোধের বিষ বৃক্ষের শিকড় যে অনেকটা গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। এই বিষ বৃক্ষ সমূলে উপড়ে ফেলার কাজটা বেশ কঠিন। কিন্তু বাংলার অপরাধ মানচিত্র থেকে সুবোধের নামটা মুছে ফেলতে না পারলে ভবিষ্যতে সমস্যা আরও বাড়তে পারে, সেটাই ভাবাচ্ছে পুলিশ-প্রশাসনকে।