অঞ্জন রায়
লোকসভা নির্বাচনের আর বছর দুয়েক বাকি। ২০২৪ সালে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকারের হ্যাটট্রিকের আশায় বিজেপি। আর সেই হ্যাটট্রিকের স্বপ্ন পূরণে অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে (প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া যেখানে মৃদু বা নেই) এখন বেশি জোর দিচ্ছে গেরুয়া শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। কারণ, ২০২৪ সালে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে আসন কমলে সরকার গঠনে যাতে কোনও সমস্যা না হয়, সেজন্যই বাড়তি এই নজর। আর এখানেই বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নজর পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলিতে। বিশেষত একুশের নির্বাচনে অভূতপূর্ব ফলাফলের পর বাংলায় এখন প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। কিন্তু, গত কয়েকমাসে একাধিক উপনির্বাচন ও পৌরভোটের ফলে চিন্তার ফাঁজ পড়েছে গেরুয়া শিবিরের শীর্ষ নেতৃত্বের কপালে। চাপ বাড়ছে মুরলীধর সেন লেনের বিজেপি দফতরের নেতাদের।
শনিবার রাজ্যে উপনির্বাচনের ফলাফলে দুটি আসনেই হেরেছে বিজেপি। এর মধ্যে আবার আসানসোল লোকসভা আসন বিজেপিরই দখলেই ছিল। বাবুল সুপ্রিয় পদ্ম ছেড়ে এখন ঘাসফুলে। তার ছেড়ে যাওয়া আসনে এবার হারলেন বিজেপি প্রার্থী তথা বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। অথচ ২০১৯ সালে পদ্ম প্রতীকে এই আসানসোলেই বাবুল জিতেছিলেন ১ লাখ ৯৭ হাজারের বেশি ভোটে। আর সেখানে আজ বিজেপি প্রার্থী হারলেন ৩ লক্ষের বেশি ভোটে। আসানসোলে পরাজয়ের ফলে রাজ্যে বিজেপির সাংসদ সংখ্যা কমে হল ১৭।
আসানসোলের পাশাপাশি বালিগঞ্জ বিধানসভাতেও হারল বিজেপি। যদিও এই কেন্দ্রে দল জিতবে বলে আশা করেননি অতি বড় বিজেপি সমর্থকও। কিন্তু, হারের চেয়েও বিজেপি নেতৃত্বকে বেশি ভাবাচ্ছে ভোটের হার। বালিগঞ্জে ১২.৩১ শতাংশ ভোট পেয়েছে গেরুয়া শিবির। সেখানে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই আসনে তারা পেয়েছিল ২০.৯ শতাংশ ভোট। শুধু ভোটের হার কমাই নয়। বিজেপি নেতৃত্বকে ভাবাচ্ছে বিরোধী দল হিসেবে পিছিয়ে পড়াও। বাংলায় এখনও খাতায় কলমে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি। কিন্তু, পৌরভোট ও একাধিক উপনির্বাচনে দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় বিজেপিকে সরিয়ে দু নম্বরে উঠে এসেছে বামেরা। অথচ, ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে একটিও আসন পায়নি তারা।
গেরুয়া শিবিরের এই ফলের পর্যালোচনার আগে দেখতে হবে রাজ্যে বিজেপির উত্থান কীভাবে-
একসময় বাংলায় সংগঠন বলতে তেমন কিছু ছিল না বিজেপির। বাম জমানার প্রথম দিকে রাজ্যে বিরোধী দল ছিল কংগ্রেস। আর ১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর কংগ্রেসের সংগঠনে ভাঙন ধরে। খুব শীঘ্রই প্রধান বিরোধী দল হয়ে ওঠে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। বিজেপি এককভাবে প্রথম এ রাজ্যে উল্লেখযোগ্য আসন জেতে ২০০৯ সালে। দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রটি। মূলত গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সমর্থনেই ওই আসনে জেতেন যশবন্ত সিং। ২০১৪ সালে দার্জিলিং ও আসানসোলেও জেতে বিজেপি।
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের আনাগোনা বাড়ে রাজ্যে। বিজেপির তৎকালীন সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কমপক্ষে ২২ টি আসন জিতবেন তাঁরা। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী না মিললেও তার কাছাকাছি আসন জেতে বিজেপি। ১৮টি আসন পায় মোদী-শাহের দল।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফল দেখেই ২০২১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন বিজেপি নেতারা। বিধানসভা নির্বাচনের কয়েকমাস আগে গেরুয়া শিবিরে যোগ দেন তৃণমূলের একাধিক হেভিওয়েট নেতা। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছিল শুভেন্দু অধিকারীর যোগদান ঘিরে। ২০২১ সালের নির্বাচনী প্রচারে বিজেপি নেতারা দাবি করেন, ২০০-র বেশি আসন পাবেন তাঁরা। সরকার যে পরিবর্তন হবেই, সেই ব্যাপারে কার্যত নিশ্চিত ছিলেন তাঁরা। অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদীরা বারবার রাজ্যে আসেন প্রচারে।
কিন্তু, বিজেপির স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তারা পায় ৭৭টি আসন। ২০১৬ সালে যা ছিল ৩। গতবারের তুলনায় ৭৪টি আসন বাড়লেও সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যা ছুঁতে পারেনি গেরুয়া শিবির। তবে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের তকমা পায় তারা।
বিধানসভা নির্বাচনের পর একাধিক নির্বাচনে বিজেপির খারাপ ফলের কারণ কী?
বিধানসভা নির্বাচনের পর গত কয়েকমাসের ঘটনাক্রম বলছে, বাংলায় বিজেপির সংগঠনের বেহাল দশা ক্রমশ বেরিয়ে আসছে। বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিতে যাওয়া একাধিক নেতা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। ২০১৭ সালে গেরুয়া শিবিরে আসা মুকুল রায় নিজেকে এখনও বিজেপি বিধায়ক বললেও তাঁকে তৃণমূলের পতাকা হাতে তুলে নিতে দেখা গিয়েছে। রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির দ্রুত উত্থান হলেও গ্রামগঞ্জে সেভাবে সংগঠন গড়ে ওঠেনি। তার উপর গেরুয়া শিবির ক্ষমতায় আসবে ভেবে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পুরোনো দলে ফিরে গিয়েছেন। তাঁদের অনুগামীরা স্বাভাবিকভাবেই শাসকদলে ভিড়েছেন। আবার বিজেপির পুরানো কর্মীরা নির্বাচনের সময় ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, শাসকদল থেকে আসা নেতাদের বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ায়।
অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদীরা বারবার বুথ ভিত্তিক সংগঠন মজবুত করতে নির্দেশ দিয়েছেন দলের নেতাদের। ২০১৯ কিংবা ২০২১ সালে নির্বাচনে এসে অমিত শাহ বারবার বলেছেন, বুথভিত্তিক সংগঠন মজবুত করতে হবে। তবেই ভোটে লড়াই করা সম্ভব। রাজ্য নেতারা তাতে বিশেষ আমল দেননি বলে অভিযোগ। আবার বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজনৈতিক হিংসায় কর্মীরা আক্রান্ত হলেও নেতারা পাশে দাঁড়াননি বলে কর্মীরা ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন একাধিকবার।
রাজনীতির কারবারিরা বলছেন, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপির সাফল্যের পিছনে কাজ করেছিল মোদী ম্যাজিক। তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে হিংসা ঘিরে মানুষের ক্ষোভ। ২০২৪ সালেও মোদী ম্যাজিকে ভর করেই যে পশ্চিমবঙ্গে আশানুরূপ ফল হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। তার জন্য প্রয়োজন দলের সংগঠন। বিজেপিতে গোষ্ঠীকোন্দল ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছে বলে অভিযোগ। অনেকে আবার বলছেন, রাজ্য বিজেপির হাল এখন যাঁদের হাতে, তাঁরা নির্বাচনে কীভাবে লড়াই করতে হয়, তা জানেন না। এই হারের পর সংগঠনে বদল হয় কি না, কিংবা পুরানো কর্মীদের গুরুত্ব দেওয়া হয় কি না, সেটাই দেখার। সবমিলিয়ে দু’বছরের মধ্যে বিজেপি তাদের সংগঠন কতটা মজবুত করতে পারবে, তার উপর নির্ভর করতে পারে ২০২৪ সালে বাংলা থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল।
আরও পড়ুন : Shatrughan Sinha: ছাপিয়ে গেলেন বাবুলের মার্জিনকেও, প্রায় ৩ লাখ ভোটে জিতে রেকর্ড গড়লেন শত্রুঘ্ন