kolkata Drug Racket: ‘কাকু চিনি আছে’? ডাবওয়ালা মুচকি হেঁসে ৫০০ টাকায় একটু খানি ‘চিনি’ দিলেন!

Shubhendu Debnath |

Oct 05, 2021 | 3:04 PM

কলকাতার নেশার জগতে সাধারণ মধ্যবিত্তই হোক বা উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোর কিশোরী, সকলের শুরুটা হয় গাঁজা কিংবা ট্যাবলেট দিয়ে। মেয়েদের মেনোপজের ব্যাথার জন্য ব্যবহৃত টেবলেট প্যাজমো প্রক্সিমন থেকে শুরু করে এনটেন, রোহিপনল বা ক্যাটামাইন থেকে শুরু করে ডেট রেপ ড্রাগস কি না থাকে এই তালিকায়। পানীয়তে সামান্য একটু মিশিয়ে দিলেই গোটা একটা দিন আপনার জীবন থেকে উধাও।

kolkata Drug Racket: কাকু চিনি আছে? ডাবওয়ালা মুচকি হেঁসে ৫০০ টাকায় একটু খানি চিনি দিলেন!
ডাবের আড়ালেও বিক্রি হয় ডাবও (প্রতীকী ছবি)। গ্রাফিক্স - অভীক দেবনাথ

Follow Us

শুভেন্দু দেবনাথ: বলিউড বাদশা শাহরুখ খানের পুত্র আরিয়ান খান গ্রেপ্তার হয়েছেন একটি প্রমোদতরীর রেভ পার্টিতে মাদক সহ, এমনই অভিযোগ। এই খবরে মশগুল গোটা দেশ। প্রায়শই টিনসেল টাউনের মাদকাসক্তি নিয়ে হইচই হয়। এমনই নানা ঘটনায় বারবার উঠে এসেছে ‘তারকা কিড’ থেকে উচ্চবিত্ত প্রাপ্তবয়স্কদের মাদক জালে জড়িয়ে পড়ার কথা। কিন্তু, শুধু যে বলিউড সেলেব-সন্তানরা বা মুম্বই, বেঙ্গালুরুর মত মহানগরের কিশোর-কিশোরীরাই নেশার জালে জড়িয়ে পড়ছে তা নয়। আমাদের কল্লোলিনী কলকাতার ‘টিনএজ’রাও কিন্তু কোনও অংশে ‘পেছিয়ে নেই’ এই নেশার দুনিয়া থেকে। কলকাতার কিশোর কিশোরীদের নিষিদ্ধ আসক্তির খোঁজখবর করতে গিয়ে যে চিত্রটা সামনে এসেছে তা কপালে ভাঁজ ফেলার জন্য যথেষ্ট।

সকাল সাড়ে দশটা, পার্ক স্ট্রিটের অফিস পাড়ার সবে ঘুম ভাঙছে। আড়মোড়া ভেঙে দোকানগুলোর শাটার উঠে যাচ্ছে একে একে। রাস্তাঘাটে গাড়িঘোড়ার মাঝে মাঝে ইতিউতি স্কুল ইউনিফর্ম পরা ছেলেমেয়ের দল। একটি হলুদ বাস এসে থামলো পার্ক স্ট্রিটের নামী কনভেন্ট স্কুলের গেট থেকে একটু দূরে। হুল্লোড়ে নেমে আসছে ছেলে মেয়েরা। পেছনের সিটে বসা দুটি মেয়ের একেবারে তাড়া নেই। বরং সতর্ক চোখে দেখছে স্কুল গেট। অন্যান্য ছেলে মেয়েদের সঙ্গে, বাস থেকে নামল তারা। সকলেই ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে স্কুল গেটের দিকে। আর এদিকে, ধীরে ধীরে হাঁটার গতি কমিয়ে অন্যান্যদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে ঢুকে পড়ল পাশের গলিতে। স্কুল থেকে ঠিক দশ পা দূরে একটা ডাবওয়ালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো দুজনে। “কাকু চিনি আছে?” ডাবওয়ালার কাছে চিনি! ব্যাপারটা কি? ডাবওয়ালা মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলো ‘কতটা’? একজন বলল ‘হাফ’। নীচের ঝোলা থেকে হাত ঢুকিয়ে ডাবওয়ালা বের করে আনলো নিজের মুঠো। তারপর গুঁজে দিলো মেয়েটির হাতে। মেয়েটিও মুঠোর মধ্যেকার জিনিসটা পার্সের ভেতর চালান দিয়ে বার করে আনলো চকচকে পাঁচশো টাকার নোট। গুঁজে দিলো ডাবওয়ালার হাতে। এরপর সোজা হাঁটা দিল পার্ক স্ট্রিট কবরখানার দিকে।

ওদের নাম টিউলিপ আর অস্মিতা (নাম পরিবর্তিত)। নামী কনভেন্ট স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্রী। আলাপ জমাতেই জানা গেল ওদের গল্প।‘এই যে স্কুল বাঙ্ক করো, বাড়িতে বা স্কুলে কেস খাও না?’ প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই ধেয়ে এল উত্তর, ‘কামঅন ইয়ার, বোকা বোকা কথা বোলোনা তো। ওসব ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে। স্কুল কামাই করলে আজকাল কোন কেস নেই। মা কিংবা বাবার সই নকল করা তো জলভাত’। একথা বলেই দু বান্ধবীর হাই ফাইভ। কতদিন ধরে নেশা করছে প্রশ্ন করায় জানা যায় প্রায় এক বছর। কী ভাবে শুরু করলে? ওদের মুখেই শোনা গেলো সিনিয়ার এক দাদার হাত ধরেই কবরখানায় প্রবেশ। তারপর ‘চিনি’র (হেরোইন) নেশা। এখন রেগুলার। বাড়িতে ধরা পড়ার ভয় নেই? নেশার টাকা জোগাড় হয় কীভাবে? ‘ধুর বাড়ির লোকের এত টাইম কোথায়? মা পাপা দুজনেই বিজি। বাড়ী ফিরতে ফিরতে দশটা, ততক্ষণে আমি নিজের ঘরে। আর টাকা তো বাবা মাই দেয়। মাসে আমার পকেট মানি ৫ হাজার টাকা”।

দুপুর সাড়ে তিনটে। মধ্য কলকাতার এক নামী রেস্তোরার হুক্কা পার্লার। এর মধ্যেই বেশ ভিড়। সমস্ত অল্প বয়েসী ছেলেমেয়ে। ক্লাস এইট থেকে শুরু করে বড়রাও আছে। পার্লারের গেটে সাদা কাগজের প্রিন্ট আউট সাঁটা- ‘২১ বছরের নীচে প্রবেশ নিষদ্ধ’। কিন্তু ভেতরে আইনের চোখে বুড়ো আঙুল। সেখানে যেমন ১৪ বছর বয়সী রয়েছ, তেমনি ২৪-এরও আনাগোনা। আলো আঁধারিতে চারিদিকে সোফা কৌচ, মাঝে সেন্টার টেবিলে হুক্কার বেস রাখা। নল হাতে এক এক জনের ধূম উদ্গীরণ। বয়েসের বালাই নেই, কেউ কেউ আবার উদ্দাম গানের তালে নেচে যাচ্ছে। যে কোন হুক্কা পার্লারের পরিচিত ছবি। ছবিটা বদলে যেতে শুরু করে সন্ধ্যে ৭টায়। অল্প বয়েসীদের দল তো আছেই, সেই সঙ্গে আরেক দলও আছে। যারা এসেছে বাবা মায়ের সঙ্গে। এক সঙ্গে একই নলে চলছে অবিভাবকের সঙ্গে হুক্কা বিহার। তারই মাঝে তাদের হাত থেকেই সিগারেটের কাউন্টার অথবা দু এক সিপ মদ্যপান। ছবিটার কুশীলবরা যে সবাই উচ্চবিত্ত তা নয়। বরং উচ্চবিত্তরা যেমন আছেন, তেমনই আছেন মধ্যবিত্ত ঘরের অবিভাবক ও তাঁদের ছেলে মেয়েরা। শুধু অ্যালকোহল বা হুক্কাই? তবে যে শোনা যায় রাত বাড়লে অন্য রঙও দেখা যায় এই সব পার্লার আর ডিস্কো থেকে যার ডাকনাম ‘ডিস্ক’! এই ডিস্কগুলিতে থাকে কিছু প্রাইভেট রুম। ডিস্কে আসা সবার কিন্তু সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। যাদের আছে, তারা ‘স্পেশাল’। সেখানে কোথাও বছর পনেরোর কিশোরী মধ্য চল্লিশের প্রায় কোলে উঠে পড়েছে, ঠোঁটে গোঁজা গঞ্জিকা। কোথাও দুই অপ্রাপ্ত বয়স্ক যুগল যা করছে তা হলি-বলির সিনেমাকেও হার মানায়। এই সব রুমে বেয়ারার হাতের প্লেটে থাকে পাকানো সিগারেটের মত বস্তু। যার পোশাকি নাম গঙ্গা-যমুনা। আসলে হাসিস আর মারিজুয়ানার কম্বো।

কলকাতার নেশার জগতে সাধারণ মধ্যবিত্তই হোক বা উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোর কিশোরী, সকলের শুরুটা হয় গাঁজা কিংবা ট্যাবলেট দিয়ে। মেয়েদের মেনোপজের ব্যাথার জন্য ব্যবহৃত টেবলেট প্যাজমো প্রক্সিমন থেকে শুরু করে এনটেন, রোহিপনল বা ক্যাটামাইন থেকে শুরু করে ডেট রেপ ড্রাগস কি না থাকে এই তালিকায়। পানীয়তে সামান্য একটু মিশিয়ে দিলেই গোটা একটা দিন আপনার জীবন থেকে উধাও।

কোথায় কোথায় বিক্রি হয় এসব? বহু ক্ষেত্রে বড় বড় স্কুল কলেজগুলোর সামনে একটু আড়াল করেই চলছে নেশার কারবার। চোখ কান খোলা রাখলেই দেখতে পাওয়া যায়। ডাবওয়ালা, পান বিড়ির ছোট গুমটি তো আছেই। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন কেমিস্টের দোকান। এখানে প্রায় বিনা প্রেসক্রিপশনেই অল্প বয়সীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে কড়া ডোজের ট্যাবলেট। পার্ক  স্ট্রিট মেট্রোর উল্টোদিকের ময়দানটি তো ড্রাগ পেডলারদের রীতিমতো আখড়া। একটু বেলার দিকে ঘন জঙ্গলের ঝোপে চটের ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাদের। এছাড়াও পার্ক স্ট্রীটের অলিতে গলিতে, রায়েড স্ট্রিট, রিপন লেন, এলিয়ট রোড, মির্জা গালিব স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, জান বাজার, মল্লিক বাজার, জগু বাজার, নন্দন চত্তর, গড়িয়াহাট, ঢাকুরিয়া লেক, দক্ষিনাপণ, ধর্মতলা, নিউমার্কেট। সর্বত্রই রমরমিয়ে চলছে এই নেশার কারবার।

শুধু মধ্য বা দক্ষিণ কলকাতা নয়, লেকটাউন, দমদম, চিড়িয়ামোড়, শ্যামবাজার সহ উত্তরেও রয়েছে এইসব ঠেক। এক কথায় টালা থেকে টলি, বারাসাত থেকে বালি সর্বত্রই বিরাজ করছে এইসব ঠেক। কখনো ডাবওয়ালা, কখনো আইস্ক্রিম বিক্রেতা, ঘটি-গরম বিক্রেতা, কাকে ছেড়ে কাকে ধরবেন? বলছি না এই সব পেশার সকলেই নেশার কারবারি। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেশার ঠেক গুলো এঁরাই চালনা করেন। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব জানেন আইনের রক্ষকরা। কারা কোথায়, কীভাবে এসব কেনা বেচা করে, কিন্তু আইন যেমন আছে, তেমনি তার ফাঁকও আছে। ফলে বহু জায়গাতেই আইনের রক্ষকদের সম্মতিতেই চলে এসব কারবার। মাঝে মাঝে লোক দেখানো ‘রেইড’ চলে কিন্তু সেসব কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে সমস্যা হয় যখন কোনও বড় কর্তার নির্দেশে ‘রেইড’ হয়। তখনই একটু হইচই হয়, কড়াকড়ি হয়, তারপর মাস ঘুরতে না ঘুরতেই আবার যে কে সেই।

এছাড়া, রেভ পার্টিও অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার থেকে সামান্য দূরে। বিশেষত দিল্লি রোড, কল্যাণী এক্সপ্রেস ওয়ের কিছু বার, গেস্ট হাউস এবং বাগানবাড়িতে বসে এই আসর। সবই জানা আইনের রক্ষকদের, তবু কোনও এক অজানা কারণে চোখ বন্ধ করে থাকেন তারা।

আরও পড়ুন: ‘বিছানা ছেড়ে একবার বেরিয়ে যাওয়ার পর, কেউ কথা রাখে না’, আক্ষেপ ‘সোনাজয়ী’ কলগার্লের

Next Article