‘বিছানা ছেড়ে একবার বেরিয়ে যাওয়ার পর, কেউ কথা রাখে না’, আক্ষেপ ‘সোনাজয়ী’ কলগার্লের
Massage Parlor Crime: মা চেয়েছিলেন মেয়ে নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ুক। দমদমের একটি নামী স্কুলে পড়া তনভি চোস্ত ইংরেজি বলেন। একজন প্রতিভাবান অ্যাথলিটও তিনি। ক্যারাটেতে ব্ল্যাকবেল্ট। জেলাস্তর পেরিয়ে রাজ্যস্তরে দুটি সোনা, জাতীয় স্তরে সোনা, এমনকী আন্তর্জাতিক স্তরেও সোনা রয়েছে তাঁর।
রাত ৮টা, কলকাতার একটি গেস্টহাউজ কাম মাসাজ পার্লারে ঢুকলেন গোয়েন্দা দফতরের এক তাবড় আধিকারিক। তড়িঘড়ি এল মদের বোতল। ব্যতিব্যস্ত কর্মীরা। খাটের উপর পা ছাড়িয়ে বসলেন তিনি, ম্যাজমেজে শরীরটাকে চাঙ্গা করতে হবে। ইশারায় বুঝিয়ে দিতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় কর্মীরা। মিনিট পাঁচেক পরেই ঘরে ঢোকে বছর উনিশের একটি মেয়ে। খানিকটা সংকুচিত, অপ্রস্তুত ভাব। ভ্রু নাচিয়ে তাঁকে পাশে বসার আদেশ দেন ওই আধিকারিক। মেয়েটি বসতেই মদের গ্লাস বাড়িয়ে দেন তিনি। সসংকোচে মেয়েটি অস্বীকার করেন। এরপর গায়ে হাত দিতেই ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলে মেয়েটি। দুঁদে গোয়েন্দা বুঝে যান, এই মেয়ে ‘লাইনের নয়’। অভয় দিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই মেয়েটি জানায় সেদিনই তাঁর প্রথম ‘কাজে আসা’। এরপর কাঁদতে কাঁদতেই জীবনের গল্প শোনান তিনি।
তনভি সিং (নাম পরিবর্তিত)। বয়স ১৯ বছর। বাবা বিহারি, মা বাঙালি। মেয়ে হয়ে জন্মানোর অপরাধে শৈশবেই তাকে বিহারে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঠাকুমার কাছে। কিন্তু গঞ্জনা সহ্য করতে না পেরেই আবারও তার ফিরে আসা কলকাতায়। এরপর ভাই জন্মানোতেই মাকে ছেড়ে যায় বাবা। অভিযোগ, এখন আর ‘আকর্ষণীয়’ নন তিনি, ইংরেজিও বলতে পারেন না, এখনকার মেয়েদের মতো স্মার্টও নন।
শুরু হয় মা-মেয়ে-ছেলের একা বাঁচা। মা চেয়েছিলেন মেয়ে নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ুক। দমদমের একটি নামী স্কুলে পড়া তনভি চোস্ত ইংরেজি বলেন। একজন প্রতিভাবান অ্যাথলিটও তিনি। ক্যারাটেতে ব্ল্যাকবেল্ট। জেলাস্তর পেরিয়ে রাজ্যস্তরে দুটি সোনা, জাতীয় স্তরে সোনা, এমনকী আন্তর্জাতিক স্তরেও সোনা রয়েছে তাঁর। অর্থাভাবে খেলার দুনিয়ায় রাজনীতি এবং বঞ্চনার শিকার তিনি। এমনিতেই খেলাধুলার দামি সরঞ্জাম কেনার ক্ষমতা ছিল না। তাও ছোটবেলার কোচ কিছু কিছু সাহায্য করতেন নিজের পকেট থেকে। কিন্তু সে আর কতটুকু!
আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গেলে ‘হানা’ কিংবা ‘অ্যাডিডাস’ কোম্পানির সরঞ্জাম ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক। যা কেনার ক্ষমতা নেই তনভির। তাছাড়া জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে তিনি দেখেছেন, প্রত্যেক প্রতিযোগীর ব্যক্তিগত কোচ রয়েছে। সেই কোচেদের আবার পরিচিতি রয়েছে খেলার বিচারকদের সঙ্গেও। খেলা চলাকালীন সামান্য চোখের ইশারাতেও পয়েন্টের হেরফের হয়ে যেতে দেখেছেন তিনি।
যাইহোক, ভাল মন্দ মিশিয়েই চলছিল জীবন। এর মধ্যেই বয়সে ছোট এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্ক হয় তনভির মায়ের। কিছুদিন পরেই আসল রূপ প্রকাশ পায় ওই যুবকের। বেশ প্রভাবশালী ওই যুবকের যোগ রয়েছে অপরাধ জগতের সঙ্গে। পুলিশ মহলেও তার দহরম মহরম প্রবল। একদিন তনভির মায়ের ব্যবসার গাড়িটি নিয়ে অ্যাকসিডেন্ট করে বসে সে। পুলিশ গাড়ি তুলে নিয়ে যায়, কিন্তু কোনও এক অজানা কারণে ছাড়া পেয়ে যায় ওই যুবক। ওই যুবক মায়ের মাথায় চাপিয়ে দেয় প্রায় ৪০ লক্ষ টাকার দেনা। হুমকি দেয়, পুলিশের কাছে গেলে শেষ করে দেবে দুই সন্তানকে। ভয় না পেয়ে পুলিশে গেলেও কাজ হয় না। উল্টে পুলিশ তাদেরই হয়রান করতে থাকে।
এর মধ্যে তনভি সল্টলেকের এক নামি এয়ারহোস্টেস ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হয়। প্রতিশ্রুতি ছিল ট্রেনিং শেষে চাকরি। কিন্তু সমস্ত টাকা জমা দেওয়ার পরও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় ওই সংস্থা। পুলিশে অভিযোগ জানাতে গেলে বলা হয়, অভিযোগ জানিয়ে লাভ হবে না কোনও। আগে থেকেই এত কেস পড়ে আছে। তার মধ্যে এটাও একটা নতুন সংযোজন হবে মাত্র। সেই থেকেই আইনের উপর থেকে ভরসা উঠে যায় মা-মেয়ের।
ইতিমধ্যে নতুন সমস্যা বয়ে আনে অতিমারি। মায়ের ব্যবসা যেটুকু বা চলছিল, এখন লকডাউনে সেটুকুও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অসুস্থ হয়ে পড়েন মা। ভাইয়ের পড়াশোনা, মায়ের চিকিৎসা, দেনার ভার, সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে ১৯ বছর বয়সীর কাঁধে। অনেক অনেক টাকা চাই দ্রুত। এদিকে সাধারণ চাকরিতে বড়জোর সাত,আট বা দশ হাজার টাকা মাইনে। তাতে সংসার, মায়ের চিকিৎসা, গাড়ির লোন, ভাইয়ের লেখাপড়া সবকিছু সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় মনে পড়ে, বন্ধুদের কাছে শুনেছিল এসকর্ট সার্ভিস, মাসাজ পার্লারে চটজলদি প্রচুর রোজগার করা যায়। তাই গুগলে খুঁজে খুঁজে নিজেই যোগাযোগ করেন সল্টলেকের এক হাই প্রোফাইল মাসাজ পার্লারের সঙ্গে।
এসব শুনে আর গায়ে হাত দেন না ওই আধিকারিক। বরং বলেন, তাঁরও নিজের স্ত্রীর সঙ্গে সমস্যা রয়েছে। তাই মাঝে মাঝে এখানে আসেন। তনভির খেলার, পড়াশুনার সার্টিফিকেট চান তিনি। দিন কয়েকের মধ্যেই চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান তিনি। আশায় দিন গোনে ১৯ বছরের ছোট্ট মেয়েটি। ফোন আজ আসবে, কাল আসবে, কিন্তু দিন পেরিয়ে যায়, ফোন আর আসে না। এমনকী নিজে থেকে ফোন করলেও কেটে দেন ওই আধিকারিক। অপেক্ষা করতে করতে তনভি বোঝেন, আলো আঁধারির এই ঘরের তিন ফুট বাই সাত ফুটের বিছানা ছেড়ে একবার বেরিয়ে যাওয়ার পর, ‘কেউ কথা রাখে না’।
এরপর এক রাতে ওই মাসাজ পার্লারে আসেন আরেক পুলিশকর্তা। তিনিও পাশে বসিয়ে গল্প শোনেন তনভির, মদ খান, এবং শুধু মাসাজ নিয়ে তিনিও চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যান এবং ফিরেও আসেন একদিন। কিন্তু সেদিন আর ম্যাসিওর হিসেবে তনভিকে নয় বরং এক মডেলকে চান তিনি। পুলিশের টিআই প্যারেডের মতো মেয়েদের দল যখন ওই কর্তার মাসাজ রুমে যায়, তখন তনভিকে নয় বরং এক উঠতি স্ট্রাগলার মডেলকে ম্যাসিওর হিসেবে বেছে নেন তিনি। তনভিকে কথা দিয়ে কথা না রাখা মানুষের তালিকা বাড়তেই থাকে। কিন্তু তনভি থেকে যায় সেই আলো আঁধারিতে ভরা ম্যাসাজ রুমেই।
দিন কয়েক পর মাসাজ পার্লারের এজেন্ট তাঁকে আরও তিনজন মেয়ের সঙ্গে কলকাতার এক নামী পাঁচতারা হোটেলে পাঠায়। ক্লায়েন্ট এক সেলিব্রেটি ক্রিকেটার। যিনি এক সময় বাংলা দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন, জাতীয় দলের হয়েও খেলেছেন। পাশাপাশি খেলেছেন আইপিএলের মত বিশ্বের এক নম্বর টি-২০ লীগেও। সেই ক্রিকেটার তনভিকে মদ খাওয়ার অনুরোধ করায় অস্বীকার করেন তিনি। বাকি তিন মেয়ের সঙ্গে সারা রাত ওই ক্রিকেটারের যৌন খিদে মেটাতে হয় তনভিকে। সকালে উঠে তাঁর দাম বাবদ ২৫ হাজার টাকা ধরিয়ে দেয় ওই ক্রিকেটার। তা নিয়ে এসে এজেন্টের হাতে তুলে দিতে হবে। সেখান থেকে সে পাবে মাত্র ১৫০০ টাকা।
এখন আর কাউকেই বিশ্বাস হয় না তনভির। নিজের কথা বলতে বলায় ঝাঁঝের সঙ্গে উত্তর আসে, “লাভ কী? যা দেখার দেখে নিয়েছি। আইনের রক্ষকরাই তো এখানে আসে, সব জানে তারা। তারপরও যদি এসব চলে, তাহলে এসব নিয়ে প্রতিবাদ করে লাভ কি? আমার অবস্থা বদলাবে না। খেলার ক্ষেত্রেও দেখেছি, আর এখন আরও দেখেছি। কী হবে এসব বলে। আইন শুধু প্রভাবশালীদের কথাই শোনে। মায়ের ব্যাপারেও দেখলাম, গাড়ি তো আজও থানায় পড়ে আছে, অথচ লোনের টাকা দিয়ে যেতে হচ্ছে। আসল অপরাধী তো প্রভাব খাটিয়ে ছাড়া পেয়ে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
কথা বলতে বলতেই ফোন আসে তনভির মায়ের। ইশারায় চুপ থাকতে বলে ফোন ধরেন তিনি। মাকে জানায় আজ তাঁর নাইট ডিউটি, ফিরতে পারবেন না। কল সেন্টারে এমন হয়, তাঁর রাতের খাওয়া হয়ে গিয়েছে। চিন্তিত মা ভরসা পান, ধরে নেন মেয়ে তার নিরাপদে আছে, এবার নিশ্চিন্তে ঘুমাবেন মা।
আরও পড়ুন: (প্রথম পর্ব) Massage Parlors Crime:শুধুই পেটের টান নয়, শখ পূরণের জন্যও যৌন পরিষেবা দিতে ম্যাসাজ পার্লারমুখী মফস্বলের মেয়েরা