Massage Parlors Crime:শুধুই পেটের টান নয়, শখ পূরণের জন্যও যৌন পরিষেবা দিতে ম্যাসাজ পার্লারমুখী মফস্বলের মেয়েরা

করোনা (covid-19) পরবর্তী সময়ে মাসাজ পার্লারগুলিতে (massage parlor) যোগ দেওয়া সমস্ত মেয়েদেরই বক্তব্য এক। গত দু'বছর ধরে করোনা মহামারীর (pandemic) কারণে তৈরি হওয়া অর্থাভাবই তাদের এই পেশায় টেনে এনেছে। এদের কারও স্বামীর বা নিজেদের লকডাউনে (lockdown) চাকরি গিয়েছে। অথবা দুজনের কারও চাকরিই যায়নি, কিন্তু মাইনে কমায় বাধ্য হয়েছে এখানে আসতে।

Massage Parlors Crime:শুধুই পেটের টান নয়, শখ পূরণের জন্যও যৌন পরিষেবা দিতে ম্যাসাজ পার্লারমুখী মফস্বলের মেয়েরা
Follow Us:
| Updated on: Sep 24, 2021 | 6:42 PM

শুভেন্দু দেবনাথ: ভুবনায়ন উপভোক্তা সত্ত্বায় মোক্ষম বহুমাত্রিকতা যোগ করেছে। আরও সুখে বাঁচার নেশায় বুঁদ সকলে। চাহিদার তালিকা এখন তৈরি করে দিচ্ছে অদৃশ্য এক শক্তি। আর সেই চাহিদা মেটাতে আমরা বাজি ধরছি সব কিছু। এই চাহিদাগুলির একটির নাম- ‘ম্যাসাজ পার্লার'( massage parlor)। শরীরের ক্লান্তি মেটানোর পাশাপাশি শরীরি ক্ষুধা নিবৃত্তিতেও যা সদা প্রস্তুত। ভারতে করোনা আসার আগে এই পার্লারগুলির চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেড়েছে এই পেশায় মেয়েদের চাহিদাও। বিশ্বায়েনের ফলে ম্যাসাজ পার্লার এবং স্পাগুলির (Spa) জনপ্রিয়তা তো ছিলই, তার মধ্যে যৌনতার ছোঁয়া লাগায় এগুলির জনপ্রিয়তায় বাড়তি মাত্রা যোগ হয়েছে। এরপর করোনা কালে (covid-19) কিঞ্চিত বিধি-নিষেধ বলবৎ হলেও, অচিরেই স্বকীয় মেজাজে ফিরে এসেছে ‘হ্যাপি এন্ডিং’ (যৌনতা দিয়ে যে ম্যাসাজ শেষ হয়)-এর খেলা। করোনার কামড় একটু শিথিল হতেই (হয়েছে কি?) দাতা-গ্রহিতার ধুম লেগেছে ‘পার্লার’-এর হৃদকমলে। কিন্তু, কোথা থেকে আসছেন এত মেয়ে? কেন আসছে? কত দূর জাল বুনেছে ম্যাসাজ পার্লার অর্থনীতি? টিভি৯ বাংলা ডিজিটালের অন্তর্তদন্তে উঠে আসছে চেনা সমাজের মাঝে বয়ে চলা এক অচেনা জীবন স্রোতের হাল হকিকত। চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায় – প্রথম পর্ব।

দৃশ্য এক। লকডাউনের (Lockdown) পর স্বামী বেকার। বাচ্চাদের পড়াতেন, দু’বছর ধরে তা-ও বন্ধ। সংসার কোনওমতে চলছিল। লকডাউন একটু শিথিল হতেই শিয়ালদা-বনগাঁর ট্রেন ধরতে বাধ্য হন পূর্ণিমা (নাম পরিবর্তিত)। দৃশ্য দুই। স্বামী অনেক আগেই কেটে পড়েছে। দুই ছেলেকে নিয়ে কোনওরকমে দিন গুজরান করছিলেন চম্পা (নাম পরিবর্তিত)। এক জন বছর ছয়েক, আর এক জন দু’বছর। কোলের ছেলেটির জন্য বাধ সাধছিল এতদিন। প্রায় দু’বছর লকডাউনের জেরে নিঃস্ব হওয়ার পর চম্পাও একই ট্রেন ধরে। আসলে কাহিনিগুলো মোটের উপর এক, ট্রেনও এক, গন্তব্যও এক।

সোদপুর, খড়দহ, সোনারপুর, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর – বিভিন্ন জায়গা থেকে মেয়েরা ভিড় করছে কলকাতা ও তার শহরতলিতে। করোনাকালে মাসাজ পার্লারের কাটতি এখন আকাশছোঁয়া। পার্লারগুলিতে কর্পোরেট ছোঁয়া লাগায় যৌনতা মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল আগেই, এ বার পেটের টানে শহরতলি থেকে ভিড় জমাচ্ছেন বহু মেয়ে। বিভিন্ন জেলা থেকে মূলত মফঃস্বলের মেয়েরা আসছেন শহরের পার্লারগুলিতে কাজ করতে। কেউ অজান্তে, কেউ বা স্বেচ্ছায় পার্লারের কাজের নামে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন। আর তা হচ্ছে একেবারে দিনে দুপুরে, প্রকাশ্যে, আপনার পাড়ার অলিগিলতে।

মফস্বলের মেয়েরা

কলকাতার মাসাজ বা স্পা পার্লারগুলিতে কাজ করতে আসেন অধিকাংশ দুই ২৪ পরগনার বাসিন্দা। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট, বারাসত, মধ্যমগ্রাম,বারাকপুর, সোদপুর, খড়দহ এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সোনারপুর, বজবজ, বারুইপুর, ডায়মন্ড হারবার থেকে মেয়েরা আসছেন এই পেশায় আসছে। তবে পিছিয়ে নেই হুগলির চুঁচুড়া, চন্দননগর, ব্যান্ডেলের পাশাপাশি দুই বর্ধমান। এমনকী রানাঘাট, কৃষ্ণনগর এবং নৈহাটির পর থেকে রেললাইনের কাছাকাছি থাকা অঞ্চলের মেয়েদের এই পেশায় যুক্ত হওয়ার হার বাড়ছে। এই সমস্ত মেয়েদের বাড়ির লোকেরা জানেন, তাদের মেয়েরা পার্লারে বিউটিশিয়ানের কাজ করে, নয়ত কোনও প্রসাধন সামগ্রীর দোকানের সেলস গার্ল বা অন্যান্য ছোটোখাটো দোকান বা অফিসে কাজ করেন।

কেন বেছে নিচ্ছেন তারা এই পেশা?

কলকাতা ও তৎসংলগ্ন শহরতলির মাসাজ পার্লারগুলির অলিগলি ঘুরে যে ছবি সামনে উঠে আসছে তা কোনওমতেই স্বস্তিদায়ক নয়। এই পার্লারগুলিতে কর্মরত নারী ও পুরুষ ম্যাসিউরদের সঙ্গে কথা বলার পর এই পেশায় যুক্ত হওয়ার কারণগুলিকে সময়কাল ধরে দুটো ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। করোনা পূর্ববর্তী এবং করোনা পরবর্তী কারণ।

করোনা কালের আগে কয়েক বছর ধরেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল মাসাজ পার্লার। অবাধ যৌনতার সহজ ঠিকানা কলকাতার সোনাগাছি, হাড়কাটা গলি, কালীঘাট যৌনপল্লী-সহ বিভিন্ন জেলার যৌনপল্লীগুলির অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অব্যবস্থা, এবং যৌনকর্মীদের দুর্ব্যবহার গ্রাহকদের অনেকটাই সমস্যায় ফেলে দিত। একে অপরিষ্কার, দুর্গন্ধযুক্ত, অন্ধকারময় ঘর, তার উপর দুর্ব্যবহার, এসবই যৌনতার সন্ধানকারীদের কিছুটা প্রতিহত করছিল সেখানে যেতে। উল্টোদিকে মাসাজ পার্লারগুলির ঝাঁ চকচকে পরিবেশ, সুযোগ সুবিধার আধিক্য, সর্বপোরি নিরাপত্তা মানুষকে এই নতুন ব্যবস্থার দিকে আকর্ষিত করেছে।

আর এসব গ্রাহকদের পরিষেবা দিতে জেলার শহরগুলির মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরাই বেশি আসছে এই পেশায়। উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েরা যে এই পেশায় আসছে না তা কিন্তু নয়। একদল আসে ঝাঁ চকচকে দুনিয়ায নিজেদের মেলে ধরতে কিন্তু আর্থিক সঙ্গতি নেই। আরেক দলকে সম্পূর্ণ সংসারের প্রয়োজনে নিতান্তই বাধ্য হয়ে এই পেশায় আসতে হয়েছে। আরেক দলও আছে, যারা শুধু যৌনতার কারণেই আসে, পাশাপাশি অর্থ তাদের কাছে বাড়তি পাওনা। যদিও এই সংখ্যাটা নেহাতই হাতে গোনা। এই পেশায় যারা আসছে নেহাতই ব্যক্তিগত শখ পূরণে তাদের গড়পড়তা বয়স ১৬ থেকে ২৮।

তবে করোনা পরবর্তী সময়ে মাসাজ পার্লারগুলিতে যোগ দেওয়া সমস্ত মেয়েদেরই বক্তব্য এক। গত দু’বছর ধরে করোনা মহামারীর কারণে তৈরি হওয়া অর্থাভাবই তাদের এই পেশায় টেনে এনেছে। এদের কারও স্বামীর বা নিজেদের লকডাউনে চাকরি গিয়েছে। অথবা দুজনের কারও চাকরিই যায়নি, কিন্তু মাইনে কমায় বাধ্য হয়েছে এখানে আসতে। পূর্ণিমা পাল (নাম পরিবর্তিত) নামে বছর তিরিশের এক যুবতী যেমন। কী করে এই পেশায় আসা প্রশ্ন করতেই বললেন, “কী করব। গত বছর লকডাউনের পর থেকেই বরের চাকরি নেই। বাড়িতে বাচ্চাদের পড়াতাম। কিন্তু গত দু বছর ধরে তো সব বন্ধ। সংসার চালাব কী করে! প্রথম দু একদিন খারাপ লেগেছিল, এখন অসুবিধা হচ্ছে না।” লকডাউন পরবর্তী সময়ে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের বিবাহিত অবিবাহিত মেয়েদের এই পেশায় আসার হার রীতিমত চমকে দেওয়ার মত, এবং তা দুশ্চিন্তারও।

পেটের টান থেকে হাত খরচা

জেলা থেকে যে সমস্ত মেয়েরা মাসাজ পার্লারে কাজ করতে আসে, তারা মূলত ৫০০ টাকা থেকে ৩০০০ টাকার মাসাজ পার্লারগুলিতেই কাজ করে। কাজে নেওয়ার সময় এই পার্লারগুলি মেয়েদের যোগ্যতা, বয়স, রূপ নিয়ে মাথা ঘামায় না। এদের কাজে যোগ দেওয়ার সময় সকাল ১১টা, ছুটি রাত ৮টায়। বছর দুয়েক এই ধরনের মাসাজ পার্লারে কাজ করা অনামিকা দাসও(নাম পরিবর্তিত) রয়েছেন। এয়ারপোর্ট অঞ্চলের বাসিন্দা অনামিকার স্বামী একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের কেরানি। মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের গৃহবধু অনামিকার কথায় সংসারে তো সমস্যা আছেই, সেই সঙ্গে আমার নিজের প্রচুর খরচ রয়েছে। সব ব্যাপারে বরের কাছে হাত পাতলে পাওয়াও যায় না। বর জানত স্পা এ কাজ করি। তারপর একসঙ্গে কাজ করা এক বান্ধবী জানিয়ে দিয়েছিল বরকে। বর একদিন পার্লারে এসে হাতেনাতে ধরে ফেলে। প্রচন্ড ঝামেলা হয়। তারপর যখন দেখল রোজগারের টাকা থেকে প্রতিদিন পাঁচ-সাত হাজার টাকা তুলে দিচ্ছি, তখন আর কিছু বলা বন্ধ করে দিয়েছে। এই তো সল্টলেকে বাড়ি করছি বরের টাকায় কেনা জমিতে।”

মাসাজ পার্লারের বাকি যারা আসছে কাজ করতে তাদের কমবেশি সকলের গল্প একই। হয় তাদের স্বামী ছেড়ে চলে গিয়েছে না হয় যারা অবিবাহিত তারা চূড়ান্ত অভাবের তাড়নায় এ পথে পা বাড়িয়েছে। আর যারা বিবাহিত হয় তাদের স্বামীর রোজগার নেই কিংম্বা সে রোজগারে সংসার চলে না।এসবের বাইরে যারা আছে, তারা আরও বেশি উন্নত জীবনের লক্ষ্যেই এ পথে পা বাড়ায়।

সরকারি ভাতা

রাজ্য সরকার একের পর এক ভাতা প্রকল্প চালু করেছে বেকার তরুণ তরুণীদের জন্য। একাধিক প্রকল্প রয়েছে মহিলাদের জন্যও। সম্প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মহিলাদের জন্য চালু করেছে “লক্ষ্মী ভাণ্ডার” প্রকল্প। মহিলাদের জন্য মাসিক ৫০০ টাকার ভাতা। যার কোনও সারবত্তা নেই সংসারের জোয়াল টানা এইসব মেয়েদের কাছে। নিচ্ছেন তো সকলেই, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। মাসিক ৫০০ টাকায় তাদের সমস্যার পয়েন্ট এক শতাংশও সমাধান হচ্ছে না। তাদের ধ্যান ধারণা হল, দিচ্ছে যখন, নিচ্ছি, না নিলে অন্য কেউ নেবে। কী চাইছেন তারা?

বাগুইআটির একটি মাসাজ পার্লারে কাজ করা এক মহিলার কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়, সরকার তো এখন তোমাদের অনেক ভাতা দিচ্ছে। তাতে কাজ হচ্ছে না? ছাপার অযোগ্য ভাষা প্রয়োগ করে তার বক্তব্য, “কত টাকায় সংসার চলে দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) কি কোনওদিন চালিয়ে দেখেছেন!ছেলের স্কুল, বইখাতার খরচ, মাস্টারের টাকা, রান্নার গ্যাস, বাজার সব মিলিয়ে মাসে কত লাগে কোনও ধারণা আছে ওঁনার। মাসে ছেলের মাস্টারের পেছনেই চলে যায় বারোশো টাকা। তার উপর রোগ বিসুখ তো আছেই। ৫০০ টাকায় এতকিছু হয়তো ওনার বাড়িতে হতে পারে। এর চেয়ে যদি কিছু কাজের ব্যবস্থা করতেন, তাও খেয়েপরে সম্মানের সঙ্গে হয়ত বাঁচতে পারতাম। রোজ বারুইপুর থেকে হয়ত নিজেকে বেচতে আসতে হত না ট্রেন ধরে।”