Male Harassment: পুরুষের শ্লীলতাহানি হলে আদৌ কোনও আইন আছে? বিচার পাবে? জানুন সত্যটা

Male Harassment: বাসে-ট্রামে পুরুষও যৌন হেনস্থার শিকার হন। পুরুষও ট্রমায় ভোগেন। তাঁদের জন্যও, No Means No- কথাটা সত্যি। কিন্তু বিচার? এই মুহূর্তে পুরুষ যৌন হেনস্থার শিকার হলে, তাঁরা কি কোনও আইনি সাহায্য নিতে পারবেন? কোনও আইন কি আদৌ আছে?

Male Harassment: পুরুষের শ্লীলতাহানি হলে আদৌ কোনও আইন আছে? বিচার পাবে? জানুন সত্যটা
পুরুষের শ্লীলতাহানিতে কী আইন (প্রতীকী ছবি)Image Credit source: GFX- TV9 Bangla
Follow Us:
| Updated on: Sep 13, 2024 | 12:19 AM

সোশ্যাল মিডিয়ায় আলাপ… একদিন হঠাৎ নিয়ে যাওয়া হল হোটেলের ঘরে। সেখানে তখন হাজির আরও তিন যুবক। বেল্ট দিয়ে মেরে চলল যৌন নির্যাতন। সারা শরীর ভরে গেল ক্ষতচিহ্নে। উদ্দাম উল্লাসের সেই ছবি ওরা রেকর্ড করল মোবাইলে। ‘সব ভিডিয়ো অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হবে…’, দেওয়া হল হুমকি। রক্তচোখ দেখিয়ে টাকাও চাইল ওরা। তারপর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ। আত্মহত্যা করা ছাড়া তো আর কোনও উপায় ছিল না!

না, উপরের ঘটনাটা কোনও মহিলার সঙ্গে ঘটেনি। এখানে নির্যাতিত একজন পুরুষ। গোরক্ষপুরের ঘটনা। ২৩ বছরের যুবক কিছু মানুষের বিকৃত যৌন লালসার শিকার হন। তবে গোরক্ষপুরের যুবক কিন্তু একা নন। এমন ঘটনার শিকার বহু পুরুষ। তথ্য বলছে, মহিলাদের থেকে সংখ্যাটা অনেক কম হলেও যৌন হেনস্থার শিকার হন পুরুষ। অনেকেই বলবেন, এরকমও হয়? হেনস্থা তো শুধুই পুরুষেরা করে? নারীর অত ক্ষমতা আছে নাকি? বিষয়গুলো সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তাঁরা বলছেন, শুধু কলকাতা শহর জুড়েই এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে। ঘটনাগুলো সামনে আসে না, কারণ নেই কোনও আইন। দিনের পর দিন হেনস্থা হলেও পুরুষের অভিযোগ জানানোর কোনও আইনি রাস্তা নেই।

পুরুষকে যৌন নির্যাতন, শুনেছেন কখনও?

প্রতিবেদনের শুরুতেই যে ঘটনাটির কথা বলেছি, তা উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুরের। চার যুবকের হাতে যৌন হেনস্থার শিকার হওয়ার পরের দিনই তাঁর দেহ উদ্ধার হয়। আত্মঘাতী হয়েছিলেন ২৩ বছরের যুবক। ২০২৪-এর জুন মাসের ঘটনা এটি।

২০২২-এর নভেম্বর মাস। জলন্ধরের কারখানায় কর্মরত এক যুবককে অপহরণ করে জঙ্গলে নিয়ে যায় চার তরুণী। অভিযোগ ছিল, চোখ বেঁধে তরুণীরা ওই শ্রমিককে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে যৌন নির্যাতন চালায়, মাদক খাইয়ে ফেলে রেখে যায় জঙ্গলের মধ্যেই। ওঠে গণধর্ষণের অভিযোগ।

পুত্র সন্তানকেও শেখান গুড টাচ- ব্যাড টাচ

পুরুষাধিকার কর্মী নন্দিনী ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, ভারতে ৫৩ শতাংশ নাবালক বা কিশোর যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে জানাচ্ছেন, কখনও স্কুলে, কখনও হস্টেলে নির্যাতনের শিকার হয় নাবালক ছাত্ররা। শুধু তাই নয়, রাস্তার ধারের ধাবা, যেখানে অনেক ক্ষেত্রেই শিশুরা কাজ করে, সেখানে এমন অভিযোগ দিনে দিনে বাড়ছে। ওই সব ধাবায় নানা ধরনের মানুষের আনাগোনা। তাঁদের শিকার হতে হচ্ছে শিশু শ্রমিককে!

এই তো সেদিন দিল্লির জনকপুরীতে, এক নাবালককে লোভ দেখিয়ে সোজা ঘরে টেনে নিয়ে যায় প্রতিবেশী। খুঁজতে গিয়ে চমকে যান বাবা -মা। ছেলে যা বলল, তা শুনে কেঁপে ওঠেন তাঁরা। পাঁচ বছরের ওইটুকু ছেলের ওপর যৌন অত্যাচার! কী বোঝে সে! গত মে মাসের ঘটনা তো শিউরে ওঠার মতো। স্কুলের ভিতরেই ছাত্রের জামা টেনে ছিঁড়ে দেওয়া হল, শরীরের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া হল আস্ত লাঠি! ইন্টেস্টাইনের আঘাত দেখে অবাক চিকিৎসকরাও। যৌন নির্যাতন ছাড়া আর কী সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে এই ঘটনাকে? আবাসিক স্কুল, প্রাইভেট টিউশনে এই ধরনের ঘটনা তো নতুন নয়। তাই কন্যা সন্তানের মতো পুত্র সন্তানকেও শিখিয়ে দিন কোনটা ব্যাড টাচ। তবে শিশুদের যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে যে আইন আছে, তা জেন্ডার নিউট্রাল। অর্থাৎ ছেলে বা মেয়ে উভয়ের ক্ষেত্রেই সেই আইন সমানভাবে প্রযোজ্য।

কত পুরুষ নির্যাতিত হন?

২০২২ সালে ‘জাতীয় মহিলা কমিশন’ একটি সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ভারতে ১.৪ শতাংশ পুরুষ কোনও না কোনওভাবে যৌন হেনস্থার শিকার। ২০২১ সালে ভারতে ২৫০০ পুরুষ যৌন হেনস্থার অভিযোগ জানিয়েছিলেন। ২০২২-এ সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয় ৩০০০। সবাই জানেন, অভিযোগের বাইরেও অনেক অভিযোগ থাকে, যার কোনও হিসেব থাকে না, কোনও পরিসংখ্যান হয় না। অনেক সময় লজ্জায় থানায় শ্লীলতাহানির অভিযোগই করেন না পুরুষরা।

কর্পোরেটের লেডি বসের ঘরে অথবা ট্রামে বাসে…

আইন খুব বেশি নেই। তাই কেস কাছারি ও কমই হয়। তবে একটু খোঁজ নিলেই জানা যায় অনেক অভিজ্ঞতার কথা। সাইকোলজিস্ট (মনোবিদ) মধুরিমা সেনগুপ্ত জানাচ্ছেন, পেশার সুবাদে পুরুষের এমন অভিজ্ঞতার কথা তাঁকে শুনতে হয় প্রায়শই। কাউন্সেলিং করাতে গিয়ে কেউ বলেন, কর্পোরেট অফিসের মহিলা বস তাঁকে যৌনতায় বাধ্য করেছে। আবার কেউ বলেন, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে রোজ রাতে স্ত্রী বিছানায় বাধ্য করেন তাঁকে।

পুরুষের ক্ষেত্রেও No means No…

মনোবিদ মধুরিমা বলছেন, অনেক ক্লায়েন্টের কাছে শুনেছি, ভিড় মেট্রোতে বা বাসে অনেক সময় পুরুষাঙ্গ স্পর্শ করার ঘটনা ঘটে। অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে তিনি বলেন, “একবার এক যুবক সল্টলেক দিয়ে যাচ্ছিলেন। রাস্তার মাঝে তাঁকে ঘিরে কয়েকজন অশ্লীল মন্তব্য (সেক্সুয়ার কমেন্ট) করে, তাঁকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। সেই ঘটনার পর ওই যুবকের কাউন্সেলিং করাতে হয়। কয়েকমাস ধরে আতঙ্কে ভুগেছিলেন তিনি। একবার বাসে এক যুবকের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটেছিল যে তিনি বেশ কিছুদিন বাড়িতে খেতেও পারতেন না।” মধুরিমার কথায়, “শরীরটা তো সবারই নিজের। তাই Yes Means Yes, No means No- এটা সবার ক্ষেত্রেই সত্যি। একজন মেয়ের শরীর স্পর্শ করলে তার যে কষ্ট হয়। একজন ছেলের পুরুষাঙ্গ স্পর্শ করার ট্রমাটাও তার থেকে কিছু কম নয়।”

পুরুষের হেনস্থার জন্য আইন, কী ছিল, কী আছে?

পুরুষের শ্লীলতাহানি বা যৌন হেনস্থার জন্য ভারতে আইন সেভাবে কোনদিনই ছিল না। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে একটি মাত্র জায়গা ছিল যার মাধ্যমে পুরুষও অভিযোগ জানাতে পারতেন। সেটি হল আইপিসি (IPC)-র ৩৭৭ ধারা।

তবে সেই ধারা যে শুধুমাত্র পুরুষের জন্য ছিল তা নয়। ৩৭৭ ধারার মূল বিষয় ছিল ‘আন-ন্যাচারাল অফেন্স’ বা প্রকৃতি বিরুদ্ধ অপরাধ। প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে যদি কোনও পুরুষ, মহিলা বা অন্য কোনও পশুর সঙ্গে কেউ যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে ৩৭৭ ধারা কার্যকর করা যেত। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু ঘটলে, একজন পুরুষও অভিযোগ জানাতে পারতেন।

গত ১ জুলাই, ২০২৪ থেকে ভারতীয় দণ্ডবিধির বদলে দেশ জুড়ে কার্যকর হয়েছে ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’। সেই ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় ৩৭৭ ধারা অর্থাৎ প্রকৃতি-বিরুদ্ধ অপরাধের কোনও জায়গা নেই। পুরুষাধিকার কর্মী নন্দিনী ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এই বিষয় নিয়ে তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন ইতিমধ্যেই। পুরুষের আইনি অধিকারের দাবিতে পথেও নেমেছিলেন তাঁরা। পুরুষও অভিযোগ জানাতে পারে, এমন কোনও আইন যাতে আনা হয়, সেই দাবি নিয়ে আগামিদিনেও আন্দোলনের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।

পুরুষের আবার হেনস্থা! আইন প্রণেতারাও কি বিশ্বাসই করেন না?

ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় কেন রাখা হল না এমন কোনও ধারা? ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজে পরিবর্তন এসেছে। এখন আর পুরুষের সঙ্গে পুরুষের সঙ্গমকে প্রকৃতি বিরুদ্ধ বলে চিহ্নিত করা হয় না। তাই ১৮৬০ সালে তৈরি ওই আইন সরিয়ে ফেলা হয়েছে।”

তবে এই মুহূর্তে পুরুষ যৌন হেনস্থার শিকার হলে, তারা কি কোনও আইনি সাহায্য নিতে পারবেন? কোনও আইন কি আদৌ আছে? এই প্রশ্নের উত্তরে আইনজীবী জয়ন্ত নারায়ন চট্টোপাধ্যায়ের স্পষ্ট জবাব, “না নেই। এমন কোনও আইনই নেই।” কেউ যদি এমন অভিযোগ জানান, কী হবে তাহলে? আইনজীবীর উত্তর, “কেউ বিশ্বাসই করবে না।” তিনি স্পষ্ট বলেছেন, “আইন প্রণেতারা এখনও ম্যাচিউরডই (পরিণত) হননি। আইন প্রণেতারা এই বিষয়টা নিয়ে কখনও ভাবেইনি।”

তবে এই প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন, আইপিসিতে ৪৯৮ অর্থাৎ গার্হস্থ্য হিংসার যে আইন ছিল, তাতে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে ভারতীয় ন্যায়সংহিতায়। বর্তমান আইনে ৪৯৮ ধারায় অভিযোগ উঠলে প্রাথমিক তদন্ত ছাড়া কোনও পুরুষকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা যায় না। এ কথা উল্লেখ করে জয়ন্ত নারায়ন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “আগামিদিনে পুরুষের যৌন হেনস্থার জন্যও কোনও আইন আসবে এই আশা রাখা যায়।”

পুরুষ কি বলার সাহস পায় না?

মনস্তত্ত্ববিদদের সমীক্ষায় বারবার উঠে এসেছে, বেশিরভাগ পুরুষ হেনস্থার কথা বলতেই পারেন না। কিন্তু কেন? মনোবিদরা বলছেন, শুধুমাত্র ভারতে নয়, অনেক দেশেই সমাজে ‘পুরুষতন্ত্র’ বিষয়টি এক বড় বাস্তব। ফলে ‘হেনস্থা করা হয়েছে’, এটা বলতে দ্বিধাবোধ করেন পুরুষেরা। কারণ তাঁরা সমাজে সবল বা শক্তিশালী বলেই বিবেচিত হন। বিশেষ করে একজন নারীর হাতে হেনস্থার শিকার হয়েছেন, এটা বললে হাসির পাত্র হয়ে যেতে হবে! এই ভয়ও কাজ করে বেশিরভাগ পুরুষের মধ্যে।

সুতরাং শুধু আইন বদল নয়, বদল দরকার সমাজেরও। থানায় এফআইআর বা আদালতে মামলা না করতে পারুক, অন্তত আত্মীয় বা বন্ধুর কাছে যেন যৌন হেনস্থার কথা সাহস করে বলতে পারেন পুরুষেরাও। কারণ সংখ্যায় কম হলেও নারীর মতোই পুরুষের যৌন হেনস্থাও একই রকম সত্যি।