সৌরভ দত্ত: এক মৃত্যু, প্রশ্ন অনেক। কোভিডে (COVID-19) আক্রান্ত হয়ে বৃহস্পতিবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে মারা যান সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষা হাসি দাশগুপ্ত (৫৭)। তাঁর মৃত্যুর পরে প্রশ্ন উঠছে, প্রবীণ প্রশাসক চিকিৎসক কি নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে দেরি করলেন?
বুধবার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে সাগর দত্তেই হাসিদেবীর করোনা পরীক্ষা হয়। অধ্যক্ষার রিপোর্ট শুধু পজিটিভ আসেনি, বুকের সিটি স্ক্যানে দেখা যায় কোভিড নিউমোনিয়া মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ডায়াবিটিস-সহ অন্য একাধিক অসুখ থাকায় রাতেই প্রবীণ প্রশাসক-চিকিৎসককে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের সিসিইউয়ে স্থানান্তর করতে হয়। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টার পরও বৃহস্পতিবার মৃত্যু হয় হাসিদেবীর।
সাগর দত্তের চিকিৎসকদের একাংশ জানান, সিটি স্ক্যানে বুকে সংক্রমণের যে ছবি মিলেছে তাতে শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ার অনেক আগেই দেহে ভাইরাসের উপস্থিতি টের পাওয়ার কথা। কর্তব্যের খাতিরে প্রবীণ চিকিৎসক হয়তো সে সবে আমল দেননি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একাংশের বক্তব্য, সময় নষ্ট না করে নমুনা পরীক্ষা কেন জরুরি প্রবীণ চিকিৎসকের মৃত্যু তা চোখে আঙুল দেখিয়ে দিল। তাঁদের দাবি, সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশের মধ্যে নমুনা পরীক্ষা করানোর ক্ষেত্রে অনীহা রয়েছে।
প্রতিদিন গড়ে ৪০ হাজারের বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হলেও তার মধ্যে আরটি-পিসিআরের তুলনায় র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের সংখ্যা বেশি। পিয়ারলেসের চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার সুদীপ্ত মিত্র বলেন, “কয়েকদিন আগেও যেখানে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ নমুনা পরীক্ষা করানো হতো। এখন তা ৭০-১০০ হয়ে গিয়েছে। অনেকে টেস্ট করাতে চাইছেন না। সাধারণ শয্যার তুলনায় সিসিইউ-আইসিইউ শয্যার চাহিদা বাড়ার পিছনেও নমুনা পরীক্ষায় দেরি একটি কারণ।” এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানান, রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের বুলেটিনে প্রতিদিনের আক্রান্তের সংখ্যা হয়তো কমেছে। কিন্তু কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনার মতো যে সব জেলায় শুরু থেকে আক্রান্তের পরিসংখ্যান স্বাস্থ্য ভবনের কর্তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে খুব একটা হেরফের ঘটেনি।
পুরো নভেম্বর জুড়েই কলকাতায় যেমন প্রতিদিনের আক্রান্তের সংখ্যা আটশো থেকে নশোর মধ্যে ওঠানামা করেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অনির্বাণ দলুই বলেন, “আমি নিজে অনেক রোগী দেখেছি যাঁরা নমুনা পরীক্ষা না করিয়েই কোভিডের ওষুধ খাচ্ছেন। এই প্রবণতা মারাত্মক। সাধারণ জ্বর ভেবে অনেকে আবার নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে গড়িমসি করছেন। নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পেতেও দেরি হচ্ছে। এ সবের পরে হাসপাতালে যখন যাচ্ছেন তখন অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
আরও পড়ুন: রোগীদের কাছ থেকে ঘর মোছারও পয়সা নেয় ডিসান! স্তম্ভিত স্বাস্থ্য কমিশন
বক্ষরোগ বিশেষজ্ঞ সুস্মিতা রায়চৌধুরীর কথায়, “কোভিড নিউমোনিয়া হলে সকলে ভাবেন তেড়ে জ্বর আসবে, শ্বাসকষ্ট, কাশি হবে। কোভিডে হ্যাপি হাইপোক্সিয়া বলে একটা বিষয় হয়। যেখানে কোনও উপসর্গই দেখা যায় না। এ জন্য পালস অক্সিমিটারে দেহে অক্সিজেনের মাত্রা দেখতে বলা হচ্ছে। অতি মহামারীতে জ্বর হলে নমুনা পরীক্ষা করা আবশ্যক।” বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান বিশ্বনাথ শর্মা সরকার জানান, একেবারে গোড়ায় রোগ এবং তার গতিবিধি বোঝা গেলে আক্রান্তকে সুস্থ করে তোলার হার অনেক বেশি। মৃত্যুর হার আটকাতে হোম আইসোলেশনে থাকা রোগীরা যাতে উপসর্গ ফুটে ওঠার সঙ্গে দ্রুত নমুনা পরীক্ষা করেন সে জন্য নির্দেশিকা জারি করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর। এরপরও এই হাল কেন? অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্সের সাধারণ সম্পাদক মানস গুমটার বক্তব্য, “নমুনা পরীক্ষা, মাস্ক পরা নিয়ে যে ধরনের সরকারি প্রচার, পদক্ষেপ প্রয়োজন তা কোথায়! কোভিড নিয়ে সরকারের আর কোনও ভাবনা-চিন্তা আছে বলে মনে হয় না।”