কমলেশ চৌধুরী: কুড়িতে আমপান, একুশে ইয়াস, বাইশে অশনি, তেইশে মোখা। ধন্যি মে বটে! তবে আমপান-ইয়াসের ক্ষতে নোনা হাওয়ার ছিটে দিতে অশনি আসেনি। মোখাও আসছে না বাংলায়। মঙ্গল-রাতেই সেই মঙ্গলময় বার্তা শুনিয়ে দিয়েছে মৌসম ভবন। মোখা যাবে বাংলাদেশ-মায়ানমার উপকূলের দিকে। রবিবার দুপুর দুপুর বাংলাদেশের কক্সবাজারের দক্ষিণে আছড়ে পড়ার সম্ভাবনা ঘূর্ণিঝড়ের। পূর্বাভাস পুরোপুরি মিলে গেলে চট্টগ্রাম ডিভিশনে বড়সড় ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা। ক্ষতি হতে পারে কক্সবাজার লাগোয়া মায়ানমার উপকূলেও। এককালে এই আরাকান অঞ্চল থেকেই মগদস্যুরা হানা দিত। এ বার সেই মগের মুলুকেই মোখার রক্তচক্ষু!
বাংলা রেহাই পেয়ে যাচ্ছে কী ভাবে?
আবহবিদরা বলছেন, সবই ‘উপরওয়ালা’র হাতে। না, পরিচিত ‘উপরওয়ালা’ ঈশ্বরের কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে বায়ুমণ্ডলের উপরিস্তরের বায়ুপ্রবাহ নিয়ে। মৌসম ভবনের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান, অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, “নিম্নচাপ হোক বা ঘূর্ণিঝড়, তার অভিমুখ নিয়ন্ত্রণ করে বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরের বায়ুপ্রবাহ। যাকে আমরা বলি, স্টিয়ারিং ফ্লো। যেমন, কোনও উচ্চচাপ বলয় বা পশ্চিমী অক্ষরেখা। খুব কম সময়ই এমন হয় যে, ঘূর্ণিঝড় স্টিয়ারিং ফ্লো-র ব্যারিকেড এড়িয়ে নিজের ইচ্ছেয় এগোতে পারে। তখন স্টিয়ারিং ফ্লো দুর্বল হতে হয় আর ঘূর্ণিঝড়কে অত্যন্ত শক্তিশালী হতে হয়। এ রকম ঘটে কম।”
আর কম ঘটে বলেই বাংলা বেঁচে যায়। একবার নয়, বারবার। সঞ্জীববাবুর কথায়, ‘‘জনমানসে প্রচলিত আলোচনা, বেশিরভাগ ঘূর্ণিঝড়ই বাংলাদেশের দিকে ঘুরে যায়। এই ‘ঘুরে যাওয়ার’ পিছনে আসলে উপরের স্তরের বায়ুপ্রবাহের হাতই থাকে।’’ এই ‘উপরওয়ালা’রা থাকে বলেই বাংলাদেশ বা মায়ানমারের চেয়ে বাংলায় ঘূর্ণিঝড়ের হানা তুলনায় কম। গত ১৩২ বছরে মে মাসে বাংলাদেশের বর্তমান সীমানায় আছড়ে পড়েছে ২৪টি ঘূর্ণিঝড়। মায়ানমারে ১৫টি, বাংলায় ৮টি ঘূর্ণিঝড়। এর মধ্যে চলতি শতাব্দীতে মাত্র দুটো। আয়লা আর আমপান। সেই তুলনায় চলতি শতাব্দীর মে মাসে বাংলাদেশে আছড়ে পড়েছে পাঁচটি ঘূর্ণিঝড়। এর পিছনে অবশ্য আরও একটা কারণ রয়েছে। তা হল উপকূলের দৈর্ঘ্য। বাংলায় উপকূল দিঘা থেকে সুন্দরবন, বড়জোর দেড়শো কিলোমিটার। বাংলাদেশে সুন্দরবন থেকে টেকনাফ, অন্তত চারশো কিলোমিটার লম্বা উপকূল। অর্থাৎ, সদর দরজা বড়।
কোন ‘উপরওয়ালা’র ব্যারিকেডে আটকে ‘বড় দরজা’র পথে এগোবে ‘মোখা’?
সঞ্জীববাবু বলছেন, ‘‘বঙ্গোপসাগরের উপর একটি উচ্চচাপ বলয় রয়েছে। এই মুহূর্তে অতি গভীর নিম্নচাপটি রয়েছে সেই উচ্চচাপ বলয়ের নীচে। খেয়াল রাখতে হবে, নিম্নচাপে বায়ুপ্রবাহ ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘোরে। উচ্চচাপ বলয়ের বায়ুপ্রবাহ ঘোরে ঘড়ির কাঁটার পথেই। এই মুহূর্তে যা অবস্থান, তাতে উচ্চচাপ বলয়ের ঘেরাটোপে উত্তর-উত্তরপশ্চিম অভিমুখে এগোবে নিম্নচাপ। উচ্চচাপ বলয়টা পেরোলেই তার প্রভাবে উত্তর-উত্তরপূর্ব অভিমুখে ঘুরে যাবে ঘূর্ণিঝড়।’’
বুধবার রাতের আপডেট, অতি গভীর নিম্নচাপ রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছিল, বুধবার দুপুরে মোখার জন্ম হয়ে যাবে। পরে পিছিয়ে বুধবার রাতের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। এখন দেখা যাচ্ছে, বৃহস্পতিবার সকালে মোখার জন্ম হতে পারে। আপাতত নিম্নচাপের যা অভিমুখ, তাতে এই পথে এগোলে দেশের পূর্ব উপকূলে পৌঁছত মোখা। কিন্তু মধ্য বঙ্গোপসাগর থেকে ডান হাতি বাঁক নেবে ঘূর্ণিঝড়। অর্থাত্, এগোবে উত্তর-উত্তরপূর্ব অভিমুখে। এই বাঁক নেওয়ার নেপথ্যেই থাকবে ভূপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ৫ হাজার কিলোমিটার উপরে থাকা উচ্চচাপ বলয়।
বঙ্গ-বন্ধু ‘উপরওয়ালা’ এই একটিই নয়। পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মেটেরোলজির জলবায়ু বিজ্ঞানী পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘ভূপৃষ্ঠ থেকে অন্তত ১১ কিলোমিটার উঁচুতে পশ্চিমী অক্ষরেখা থাকবে। এই অক্ষরেখা কিছুতেই ঘূর্ণিঝড়কে বাংলার দিকে এগোতে দেবে না।’’
ফলে শনিবার-রবিবার উপকূলের তিন জেলায় হালকা বৃষ্টি ছাড়া, বাংলায় তেমন কোনও প্রভাবই পড়বে না মোখার। অবশ্য তাপপ্রবাহের যা পরিস্থিতি, তাতে বৃষ্টি এলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আমজনতা।