তৃণমূলের টিকিটে দাঁড়ানো প্রসূন পুলিশের পরামর্শদাতা হতে পারেন? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
সম্প্রতি আরজি কর কাণ্ডে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে সব মহলেই। বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মুখে পদ থেকে সরতে হয় পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে। বিজেপি নেতারা তৃণমূল-পুলিশ যোগ নিয়ে সরব হয়েছেন একাধিকবার।
শাসক দলের সঙ্গে পুলিশ প্রশাসনের সম্পর্ক ‘নিবিড়’। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ নয়, অন্যান্য রাজ্যেও বিরোধী দলগুলি বলে থাকে, পুলিশ হল শাসক দলের হাতের পুতুল। সাধারণ পুলিশ কর্মী থেকে শুরু করে আইপিএস অফিসার সব স্তরেই রাজনৈতিক দলের প্রভাবের কথা চর্চায় উঠে আসে বিভিন্ন সময়। পশ্চিমবঙ্গে যা হল, তা সাম্প্রতিক অতীতে কোথাও হয়েছে কি না, মনে করতে পারছেন না রাজনীতিকরা।
পুলিশের পদে ইস্তফা দিয়ে অথবা অবসর নেওয়ার পর রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়া ভারতে কোনও নতুন ঘটনা নয়। একসময় পুলিশ কমিশনার পদের থাকা হুমায়ুন কবীর, পুলিশ সুপার পদ সামলানো ভারতী ঘোষরা এখন পুরোদস্তুর রাজনৈতিক কর্মী। তবে রাজনৈতিক দলে সক্রিয়ভাবে কাজ করে আবারও পুলিশ প্রশাসনে ফিরে যাওয়ার ঘটনা কার্যত নজিরবিহীন। সম্প্রতি ঠিক এভাবেই তৃণমূলের কর্মী হিসেবে কাজ করার পর রাজ্য় পুলিশের উপদেষ্টা পদ দেওয়া হল প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কোন আইনে এটা সম্ভব? বিরোধীদের অভিযোগ কি সত্যি হল?
৯ মাসের মধ্যেই আবার পুলিশ প্রশাসনে প্রসূন
উত্তর দিনাজপুরে রায়গঞ্জের আইজি ছিলেন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটের সময় তৃণমূলকে সহযোগিতা করার অভিযোগও ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে গত মার্চ মাসে আচমকাই সেই আইজি পদে ইস্তফা দেন আইপিএস প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। স্বেচ্ছাবসর বা ভিআরএস নেন তিনি। সে দিনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে এবার রাজনৈতিক পথে হাঁটতে চলেছেন প্রসূন।
এর কয়েকদিন পর তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা হতেই বোঝা যায়, সেই জল্পনা সত্যি। মালদহ উত্তর লোকসভা কেন্দ্রে টিকিট দেওয়া হয় তাঁকে। রমরমিয়ে প্রচারেও নেমে পড়েন তিনি। এমনকী প্রচার সভা থেকে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে তোপ দাগতেও শোনা যায় তাঁকে। সরাসরি বিএসএফ-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে ভোটে জেতা হয়নি তাঁর। ভোটের পর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও খুব বেশি দেখা যায়নি তাঁকে। আর ঠিক ৯ মাস পর, ডিসেম্বরে সেই প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজ্য পুলিশের আইনি উপদেষ্টা পদ দেওয়া হল।
এভাবে ‘ফিরে আসা’ কি আগে দেখা গিয়েছে?
শুরুতেই দু’জনের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। হুমায়ুন কবীর ও ভারতী ঘোষ। হুমায়ুন কবীর বর্তমানে ডেবরার বিধায়ক। চন্দননগরের পুলিশ কমিশনার ছিলেন তিনি। এছাড়া বীরভূম, পুরুলিয়ায় পুলিশ সুপারের দায়িত্বও সামলেছেন। ২০২১-এ বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে ইস্তফা দিয়ে তৃণমূলে যোগ দেন হুমায়ুন। ভোটে জিতে বিধায়কও হন।
আরও দু’বছর আগে ফিরে গেলেই মনে পড়বে ভারতী ঘোষের কথা। পাঁচ বছর ধরে পশ্চিম মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার পদে থাকা ভারতী ঘোষের তৃণমূল ঘনিষ্ঠতার কথা আলোচিত হত বিভিন্ন সময়। মমতাকে ‘মা’ সম্বোধন করা সেই আইপিএস ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে ইস্তফা দিয়ে যোগ দেন বিজেপিতে। তার আগে জেলা পুলিশ সুপার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। ভোটে টিকিট পেলেও ভারতীর সাংসদ হওয়া হয়নি। বর্তমানে বিজেপি কর্মী হিসেবেই কাজ করেন, তবে পুলিশের সঙ্গে আর কোনও যোগাযোগ নেই তাঁর। এছাড়া সারা দেশে অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসারদের রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার উদাহরণ রয়েছে ভূরি ভূরি।
কতটা ক্ষমতা থাকবে প্রসূনের হাতে?
প্রসূনের পদটি হল, রাজ্য পুলিশের আইনি উপদেষ্টা। মূলত একটি ওএসডি পদ, অর্থাৎ স্থায়ী সরকারি চাকরি নয়। তাই, আইন মেনে এই পদ পেলে কোনও অসুবিধা থাকার কথা নয় বলেই মনে করছেন প্রাক্তন পুলিশকর্তা অজয় মুখোপাধ্যায়। তবে এমন ঘটনা আগে ঘটেছে কি না, তা মনে করতে পারছেন না তিনি।
প্রাক্তন পুলিশকর্তা অজয় মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, সরকার চাইলে এভাবে পদ দিতে পারেন। তবে আইনে কোনও প্রবিশন আছে বলে আমার জানা নেই। তবে তিনি মনে করেন, আইজি হিসেবে তাঁর যে ক্ষমতা ছিল, তা আর থাকবে না। প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু পরামর্শ দিতে পারলেও তিনি কোনও নির্দেশ দিতে পারবেন না। তবে ওএসডি পদে ফেরা যায় বলেই জানিয়েছেন তিনি। পাঁচ বছর পর্যন্ত এই পদে থাকা যায়। ওএসডি হিসেবে বেতনও পাবেন তিনি। তবে প্রাক্তন কর্তা জানাচ্ছেন, সরকার মনে করলে যে কোনও অবসরপ্রাপ্ত অফিসারকে ওএসডি পদে বসাতে পারেন। বিধায়ক বা সাংসদ হলে প্রশ্ন থেকে যেত, কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি ভোটে জেতেননি, ফলে সেই প্রশ্ন আসছে না।
পুলিশের রাজনৈতিক যোগ কি আরও স্পষ্ট হচ্ছে?
রাজ্য পুলিশের বিরুদ্ধে বিরোধীদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। আর সম্প্রতি আরজি কর কাণ্ডে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে সব মহলেই। বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মুখে পদ থেকে সরতে হয় পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে। বিজেপি নেতারা তৃণমূল-পুলিশ যোগ নিয়ে সরব হয়েছেন একাধিকবার। প্রসূন তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরও বিতর্ক হয়েছিল যথেষ্ট। বিজেপি নেতা অমিত মালব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন তুলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে। এবার প্রসূন বন্দ্য়োপাধ্যায় যেভাবে তৃণমূল থেকে আবার পুলিশে ফিরলেন, তাতে অভিযোগের জোর বাড়ছে আরও।
বিজেপি নেতা জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে বলেন, “আইনি উপদেষ্টা হওয়ার জন্য কোনও আইনজীবী ছিল না! পুলিশের কাঁধে অশোকস্তম্ভ থাকলেও আমাদের চোখে ওটা জোড়াফুল দেখতে হবে।” প্রশ্ন তুলছেন বাম নেতারাও। বর্ষীয়ান সিপিএম নেতা তথা আইনজীবী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, “এরকম দক্ষিণপন্থী দলগুলি কোনও নিয়ম মানে না। কোনও নীতি কাজ করে না। এ ক্ষেত্রে প্রলোভনটা টিকিয়ে রাখা হল। বার্তা দেওয়া হল যে, তোমরা যারা উচ্চপদে আছ, তাদের পাশে সরকার থাকবে।” এভাবেই আইন-বিরোধী কাজে সবাইকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রীই যখন পুলিশমন্ত্রী!
পুলিশ প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক দলের প্রভাব উড়িয়ে দিচ্ছেন না খোদ প্রাক্তন পুলিশকর্তাও। প্রাক্তন পুলিশকর্তা অজয় মুখোপাধ্যায় বলেন, “ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, একটা সরকার থাকবে, যাদের জনগণ নির্বাচিত করবে। আর এ ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই পুলিশমন্ত্রী। পুলিশ বিভাগটি তিনি নিজে দেখেন। তাহলে তাঁর কথায় সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সেটাই স্বাভাবিক।” উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, “কার পোস্টিং কোথায় হবে, সেটাও মুখ্যমন্ত্রীই ঠিক করে দেন। সে ক্ষেত্রে ডিজি-র বলার ক্ষমতা নেই যে, ‘না, ওই অফিসারকে ওখানে পোস্টিং দেওয়া যাবে না।'”
তবে তৃণমূলের স্পষ্ট বক্তব্য, যাঁর অভিজ্ঞতা আছে, তাঁকে সরকার কাজে লাগাতেই পারে। তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ মনে করেন, অযথা এমন বিতর্ক হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে তিনি বিচারপতিদের রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার কথাও উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। কুণাল ঘোষ বলেন, “ওঁর পুলিশ বিভাগে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। তাই ওঁকে পদ দেওয়া যেতেই পারে।”