জ্ঞানে, ব্যক্তিত্বে, নেতৃত্বে যাঁরা সমাজের অনুপ্রেরণা, তাঁরাই আসল ‘নক্ষত্র’। বিশ্বমঞ্চে বারবার স্বীকৃতি পেয়েছেন বাংলার সেই নক্ষত্ররা। নোবেল পুরস্কারের মঞ্চ থেকে ক্রিকেটের ময়দান, সর্বত্র বাঙালিকে ‘সেরা’ হিসেবে দেখেছে বিশ্ববাসী। সেই নক্ষত্রদের বিশেষ সম্মাননা দিল TV9 বাংলা। আর সেই মঞ্চে বক্তব্য রাখতে গিয়ে TV9 নেটওয়ার্কে এমডি ও সিইও বরুণ দাস মনে করিয়ে দিলেন, এই নক্ষত্ররাই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারেন।
২০২৫ সালে বিশ্বে কীভাবে পট পরিবর্তন হচ্ছে, তা উল্লেখ করে এদিন এমডি বরুণ দাস বলেন, “২০২৫-এর শুরুতেই ভেবেছিলাম বছরটা একটা ‘ইনফ্লেকশন পয়েন্ট’ হতে চলেছে। গোটা বিশ্বের জনজীবনে একটা পরিবর্তন হতে পারে। জীবন আর আগের মতো থাকবে না। আমাদের কাছে দুটো অপশন থাকবে- উত্থান অথবা পতন। আমরা আর এক জায়গায় থাকব না।”
তাঁর এই ভাবনা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করে বরুণ দাস বলেন, “আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি না। দুটো বিষয় আমাকে প্রভাবিত করেছে। একটি হল এআই (AI)। চাকা, ইলেকট্রিসিটি বা এয়ার ট্রাভেল, কম্পিউটার বা ইন্টারনেটের মতো প্রযুক্তিগত আবিষ্কারগুলি মানব ইতিহাসকে একটা নতুন পথে নিয়ে গিয়েছে। তবে এই আবিষ্কারগুলোর অ্যাডভার্স এফেক্ট (প্রতিকূল প্রভাব) খুব বেশি উল্লেখযোগ্য ছিল না। কিন্তু এআই (AI) অনেকটা আলাদা। মানবজাতির উপর এর ভাল না খারাপ, কোন প্রভাবটা বেশি পড়বে, কেউ জানে না।”
দ্বিতীয় কারণ হিসেবে বরুণ দাস বলেন, জিও পলিটিক্যাল আনসার্টেনটি বা ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কথা। তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৪-এ ৬০টি দেশে নির্বাচন হয়েছে। তাই প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে এই ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এক বিরল পরিস্থিতি তৈরি করবে, যার জন্য আমাদের জীবনে পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
বরুণ দাস আরও বলেন, “আমাদের প্রতিবেশী দেশ ৫৫ বছরের রক্তাক্ত ইতিহাসকে বর্তমানে নিয়ে এসেছে। আর তারপর এলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে অর্থনীতির যে গ্লোবালাইজেশন তৈরি হয়েছিল, সেখানে চিন বাদে বড় অর্থনীতির দেশগুলো শুধু নিজেদেরটা দেখত না, অন্যের পরিপূরক হওয়ার চেষ্টা করত। কিন্তু ট্রাম্প ও তাঁর ট্য়ারিফনীতি বিশ্বের ৮০ বছরের পুরনো রীতি নাড়িয়ে দিয়েছে।”
ভারতের সঙ্গে আমেরিকার নীতির তুলনা টেনে বরুণ দাস বলেন, “আমি মনে করি ট্রাম্প আমেরিকাকে মহান করে তুলতে পারতেন। আমেরিকাবাসী সেইজন্যই তাঁকে ভোট দিয়ে এনেছেন। এতে কোনও ভুল নেই। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন বলেন ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ বা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বলেন, ‘বেঙ্গল ফার্স্ট’, সেখানে কোনও অসুবিধা নেই। তবে ট্রাম্পের নীতির সঙ্গে ভারতের নীতির একটা তফাৎ আছে।” এই প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, “আমরা জানি নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারত বিশ্বাস করে যে ভারতের উন্নয়ন ও উত্থান কারও পতনের কারণ হতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। সবাইকে নিয়ে চলার যে বিদেশনীতি, তার জন্য ভারত একটা আলাদা জায়গা তৈরি করেছে। প্রায় সব দেশই আমাদের বন্ধুত্ব চায়। এভাবেই ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।”
শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের যে একটা বড় সুযোগ আছে, সে কথাও এদিন বলেন বরুণ দাস। তিনি মনে করিয়ে দেন, বিশ্বস্তরে ভারত যখনই কোনও সাফল্য পেয়েছে, তাতে বাংলা নেতৃত্ব দিয়েছে। এমডি ও সিইও বরুণ দাস এই প্রসঙ্গে বলেন, “১৮৯৩ সালে শিকাগোতে বিবেকানন্দ যখন ভ্রাতৃত্বের আদর্শে গোটা বিশ্বকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, তার অনেক আগে থেকেই এটা শুরু হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে রামদুলাল দে প্রথম মাল্টিন্য়াশনাল ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এরপর বিজ্ঞানে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জগদীশ চন্দ্র বসু, সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়, অর্থনীতিতে অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্য়োপাধ্য়ায়, বিশ্বে যেখানেই ভারত স্বীকৃতি পেয়েছে, সেখানেই বাংলা নেতৃত্ব দিয়েছে।”
অতিথি আসনে উপস্থিত থাকা প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্য়ায়ের উদ্দেশে বরুণ দাস বলেন, “ভারতীয় ক্রিকেট টিমকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কোথায় পৌঁছে দিয়েছেন, সেটাও আমরা জানি। সেখান থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। সৌরভ যদি ফুটবল খেলতেন, তাহলে হয়ত আমরাও বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখতাম। তবে কীভাবে নেতৃত্ব দিতে হয়, তা শুধু ক্রিকেট-বিশ্বকে নয়, গোটা বিশ্বকে শিখিয়েছেন সৌরভ। আমার আশাবাদী মন বলছে, ভারত যদি বিশ্বস্তরে ‘সুপার পাওয়ার’ হয়ে ওঠে, তাহলে সেখানেও নেতৃত্ব দেবে বাঙালিরা।”
সব শেষে বরুণ দাস বলেন, “বাঙালি তরুণদের বলতে চাই, বৃহত্তর স্বপ্ন দেখো। স্বপ্নের পিছনে দৌড়াও। আর যখন স্বপ্নের পিছনে দৌড়াও তখন কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় অনুপ্রেরণার। আজ আমরা এমন কয়েকজন বাঙালিকে সম্মান দিতে চলেছি, যারা আমাদের অনুপ্রেরণা হতে পারে। আর সেই অনুপ্রেরণাই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।”
উইনস্টল চার্চিলের একটি উক্তি দিয়ে বক্তব্য শেষ করেন বরুণ দাস। তিনি বলেন, “চার্চিলের যে সবকিছু ভাল, তা বলতে পারি না। তবে তাঁর অদম্য় সাহসের সবসময় প্রশংসা করি আমি। হারাটা যে একটা অপশন এটা কখনই উনি ভাবেননি। উনি বলেছিলেন, ‘একজন নেতিবাচক ব্যক্তি সম্ভাবনার মধ্যেও আশঙ্কা খোঁজেন, আর একজন আশাবাদী মানুষ আশঙ্কার মধ্যেও সম্ভাবনা খোঁজেন।'”