গেরুয়া শিবিরে অক্সিজেন জোগাল মমতার হার
বাংলার নির্বাচনে এবার প্রথম থেকেই ছিল চমক। শেষ পর্যন্তও রয়ে গেল চমক। মমতা জয়ী ঘোষণা হওয়ার পর নাটকীয় মোড়। শেষবেলার গণনায় জিতে গেলেন শুভেন্দু। সাংবাদিকদের সামনে হার স্বীকারও করে নিলেন মমতা। ৭০-এর ঘরে আসন পেয়ে বিজেপি যখন ব্যকফুটে, তখন গেরুয়া শিবিরকে অক্সিজেন যোগাল মমতার হার। রাজ্যের মানুষের রায় মাথা পেতে নেওয়ার কথা বললেন দিলীপ ঘোষ। রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসতে না পারলেও নন্দীগ্রামের প্রেস্টিজ ফাইটে মান রক্ষা হল বিজেপির। দল বদলে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোগ উগরে দিয়েছিলেন শুভেন্দু। শান্তিকুঞ্জে একে একে পদ্ম ফোটান তিনি। তাই এই জয় তাঁর কাছে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। যদিও যতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি, ফলাফল কিন্তু ততটা সহজ হল না। মমতাও বুঝিয়ে দিলেন, অধিকারীদের খাস তালুকেও চ্যালেঞ্জ নিতে পারেন তিনি।
বঙ্গ বিজেপির প্রত্যাশা মিলন না, পিকে-তে আস্থা রেখেই বাজি জিতলেন মমতা?
২০১৬- তে তৃণমূলের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়াননি বিরোধীরা। ২০২১- এ সেই ছবি অনেকটাই বদলে যায়। ঘাসফুলকে সমূলে উৎপাটন করতে বারবার বাংলায় আসেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের মতো নেতারা। অনেক বৈঠক, ভাবনা-চিন্তা, পরিকল্পনার পর তৈরি করা হয় প্রার্থী তালিকা। কিন্তু ফলাফলে দেখা গেল কোনও হিসেবই মিলছে না বিজেপির। ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অরূপ বিশ্বাসের মতো তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের নাম জয়ের দিকে এগোচ্ছে। রাজনৈতিক মহলের মতে, প্রশান্ত কিশোরের ওপর ভরসা করে তাহলে ঠিকই করেছেন মমতা? এই প্রশান্ত কিশোরকে নিয়ে বারবার কটাক্ষ করেছে বিজেপি। দল বদলানো নেতারা বলেছেন, ‘তৃণমূল প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে’। কিন্তু শেষমেস সেই পথেই যে মমতার জয় আসছে, সেটা বেশ স্পষ্ট।
যদিও গণনা এখনও বাকি। তবে ট্রেন্ড বলছে, ২০০-র বেশি আসনে এগিয়ে তৃণমূল, অন্যদিকে ১০০ ছুঁতে পারছে না বিজেপি। উন্নয়নকে হাতিয়ার করেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয় হয়েছে, বলে উল্লেখ করছেন তৃণমূল নেতারা। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘বারবার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে যে ভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, সেটাই কার্যত কাল হয়েছে বিজেপির। এই আক্রমণ মানুষ ভালোভাবে নেননি বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।’
হিসেব বদলে যাচ্ছে দিলীপ ঘোষদের, স্বস্তি ফিরছে কালীঘাটে, প্রায় নিশ্চিহ্ন বাম-কংগ্রেস
অমিত শাহ বারবার বলেছেন ‘ইস বার, ২০০ বার’। অথচ ট্রেন্ডে ২০০ পার করে ফেলল তৃণমূল। কয়লা-কাণ্ডে যে কালীঘাটে অস্বস্তি বেড়েছিল, সেখানেই ফিরছে স্বস্তির হাসি। দিলীপ-মুকুল তথা বঙ্গ বিজেপির হিসেব নিকেষ কি পাল্টে যাচ্ছে? যদিও ছবিটা পরিষ্কার হতে এখনও কিছুক্ষণ সময় লাগবে, তবুও যেভাবে তৃণমূল ও বিজেপির আসনের ফারাক বাড়ছে, তাতে মনে করা হচ্ছে প্রত্যাবর্তনেই ভরসা রাখছে বাংলার মানুষ। বাবুল সুপ্রিয়, লকেট চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রার্থীরাও পিছিয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট কেন্দ্র। সূত্রের খবর, ফলাফল নিয়ে ইতিমধ্যেই বিজেপির অন্দরে শুরু হয়েছে কানাঘুষো। কেউ বলছেন অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসই কাল হল, আবার কেউ বলছেন, দলবদল করা নেতাদের জায়গা দিয়ে ভুল করেছে বিজেপি।
অন্যদিকে, বাংলার রাজনীতি থেকে কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসল বাম ও কংগ্রেস। আইএসএফের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সংযুক্ত মোর্চা জোট করেও যে কোন লাভ হল না তা ট্রেন্ড থেকে পরিষ্কার।এক থেকে দুটি আসনে এগিয়ে আছে সংযুক্ত মোর্চা। শিলিগুড়িতে অশোক ভট্টাচার্যের মতো প্রার্থীও ফলাফল দেখে হতাশায় গণনা কেন্দ্র ছেড়ে চলে গিয়েছেন। তরুণ তুর্কি দের জায়গা দিয়ে আশানুরূপ ফল হয়নি। ঐশী ঘোষ বা সৃজনের মতো প্রার্থীরা ভোট পেয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশের কাছাকাছি ।
নন্দীগ্রামে হাসি ফুটছে গেরুয়া শিবিরের, রাজ্যে ট্রেন্ড তৃণমূলের পক্ষে
তিন রাউন্ড গণনা শেষে নন্দীগ্রামে এগিয়ে বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী। ৮ হাজারের বেশি ভোটে এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিক ছবি দেখে মনে হচ্ছে নন্দীগ্রামের যে অংশে গণনা হয়েছে সেখানকার ২২ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট পেয়েছেন মমতা, পেয়েছেন কিছু হিন্দু ভোটও। তবে রাজ্য জুড়ে চলছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। ট্রেন্ড বজায় থাকলে তৃণমূল জয় পেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। শহর কলকাতার লাগোয়া এলাকায় বিজেপির ফল আশাজনক নয়। এমনকি যে ভবানীপুরে রুদ্রনীলকে টিকিট দিয়ে বাজিমাত করতে চেয়েছিল বিজেপি, সেখানেও এগিয়ে যাচ্ছে তৃণমূল। অন্য দিকে, অনুব্রত গড় বীরভূমে চার আসনে এগিয়ে বিজেপি। আরও চমক দিয়ে অধীর গড় বহরমপুরে এগিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। ‘সঠিক গতিতে বিজেপি এগোচ্ছে’ বলে উল্লেখ করলেন দিলীপ ঘোষ, জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী কৈলাশ বিজয়বর্গীও।
পোস্টাল ব্যালটে প্রাথমিক ট্রেন্ডে জোর টক্কর:
সকাল ৮টা থেকে শুরু হয়েছে পোস্টাল ব্যালটে গণনা। প্রাথমিক ছবি আসতে শুরু করেছে। শুরুতেই এগিয়ে যায় বিজেপি (BJP)। পরে আবার শাসক দল এগোতে শুরু করে। ১০-১২ আসনের তফাতে চলছে জোর টক্কর। ঘণ্টাখানেক পরও বলা যাচ্ছে না, কার দিকে পাল্লা ভারী। এই ছবি থেকেই স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এবার বাংলার নির্বাচনে কোনও দলেরই জয় সহজ হবে না। নন্দীগ্রামের (Nandigram) দিকে রয়েছে গোটা দেশের নজর। আর সেখানে প্রথমেই এগিয়ে যান শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari)। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) সঙ্গে চলছে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে এগিয়ে আছেন তৃণমূলের ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বিজেপি সব্যসাচী দত্ত, লকেট চট্টোপাধ্যায়, বাবুল সুপ্রিয়কে এগিয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। তবে এখনও সম্পূর্ণ ছবিটা সামনে আসতে সময় লাগবে।
বাংলার রাজনৈতিক ছবি:
১০ বছর আগে এক ‘পরিবর্তন’ দেখেছিল বাংলা। ৩৪ বছরের বাম দূর্গ ভেঙে মসনদে বসেছিলেন ‘অগ্নিকন্যা’ মমতা। পরের বার অর্থাৎ ২০১৬-তেও তেমন কোনও বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়নি তৃণমূলকে। কিন্তু ২০২১-এর আগে বদলে গিয়েছে বাংলার রাজনৈতিক চিত্র। চমক দিয়ে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ১৮টি আসন পায় বিজেপি। আত্মবিশ্বাস পান দিলীপ ঘোষরা। তারপর বাংলা দখলে কোনও খামতি রাখতে চায়নি গেরুয়া শিবির।
অন্য দিকে মমতার সামনে তৈরি হয় নতুন চ্যালেঞ্জ। ঘাসফুল শিবিরের জন্য বাংলায় আসেন ভোট কৌশলী প্রশান্ত কিশোর। এদিকে আবার তৃণমূলে ‘ভাইপো’ অভিষেকের প্রতিপত্তি অন্যতম ফ্যাক্টর হয়ে যায়। তরুণ নেতার প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় গোঁসা হয় অনেকেরই। তৃণমূলে অভিমানী নেতাদের শিবির বদল করতে দেখা যায়। ভোটের আগে পর্যন্ত যা অব্যাহত থেকেছে। নন্দীগ্রামে মমতার প্রার্থী হওয়া এই নির্বাচনের একটা বড় চমক। শুভেন্দুর যে আত্মবিশ্বাস দেখা গিয়েছে, তাতেই নন্দীগ্রামের ফলাফল নিয়ে নিশ্চিত ভাবেই কিছুই বলা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে আরও একটা পরিবর্তন কি দেখবে বাংলা? নাকি ফির আসবেন ‘বাংলার মেয়ে’ মমতা। শেষ হাসি কে হাসবে, তা জানতে আপাতত কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা।