কলকাতা: গত পাঁচ মাস ধরে নানা টালবাহানার পর অবশেষে রবীন্দ্র সরোবরের ফের চালু হল পেট্রোল দিয়ে মোটরচালিত উদ্ধারকারী নৌকা বা রেসকিউ বোট। একইসঙ্গে চালু হয়ে গেল রোয়িংও। যে কারণে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থীরাও। গত ২১ মে’র ঘটনা। ভয়ঙ্কর কালবৈশাখীর কবলে প্রাণ গিয়েছিল দুই রোয়িং শিক্ষার্থীর। বোট উল্টে লেকের জলে ডুবে মৃত্যু হয় দুই বন্ধুর। এরপরই রবীন্দ্র সরোবরে (Rabindra Sarobar) কেন উদ্ধারকারী বা রেসকিউ বোট ঘটনাস্থলে ছিল না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেই সময় রোয়িং প্রশিক্ষণ দেওয়া ক্লাবগুলি জানিয়েছিল, রেসকিউ বোট তাদের কাছে রয়েছে। কিন্তু তা পেট্রোলচালিত বোট, যা জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশে জলে নামানো যাবে না।
যদিও সেই সময় জাতীয় পরিবেশ আদালতের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, এরকম কোনও নির্দেশ তারা দেয়নি। বিষয়টি কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি বা কেএমডিএ-এর অধীনস্থ। তাই তারাই সিদ্ধান্ত নেবে এই বোট চলবে কি চলবে না। দীর্ঘ পাঁচ মাস ধরে এই টালবাহানা চলার পর অবশেষে রবীন্দ্র সরোবরের ফের পেট্রোল দিয়ে মোটরচালিত উদ্ধারকারী নৌকা বা রেসকিউ বোট চালু হল। একইসঙ্গে চালু হয়ে গেল রোয়িংও।
রবীন্দ্র সরোবরের জলে মোট তিনটি ক্লাব রোয়িং প্রশিক্ষণ দেয়। অতীতে চারটি ক্লাব থাকলেও পরিকাঠামোর অভাবে এবং আর্থিক অনটনে একটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এই তিনটি ক্লাব নিজেদের একটি বা দু’টি রেসকিউ বোট রাখবে। তবে অযথা সেই পেট্রোলচালিত নৌকাগুলিকে চালাতে পারবে না ক্লাবগুলি। যদি দুর্ঘটনা ঘটে যায় তাহলেই ওই নৌকা নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছবে। কোনওরকম জয় রাইড করা যাবে না। একই সঙ্গে কলকাতা পুলিশের তরফে যে এসওপি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে রোয়িং প্রশিক্ষণের জন্য, সেগুলি প্রতিটি ছত্রছত্রে মানতে হবে বলা হয়।
কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটির কর্তারা জানিয়েছেন, ১৫ দিন অন্তর দু’বার করে তাঁদের তরফে কেউ না কেউ ওই ক্লাবগুলিতে গিয়ে দেখবেন, নির্দেশ সঠিকভাবে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে কি হচ্ছে না। ইতিমধ্যে প্রশাসনের নির্দেশে এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য ক্লাব চত্বরে লাগানো হয়েছে লাল ও সবুজ আলো। আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস অনুযায়ী প্রতীকী চিহ্ন হিসাবে কাজ করবে এই আলো। লেক ক্লাব সূত্রে খবর, ঝড়-বৃষ্টি কিংবা বজ্রপাতের পূর্বাভাস থাকলে জ্বলে উঠবে লাল আলো। সেদিন কোনও রোয়ারকেই জলে নামার অনুমতি দেবে না ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ না থাকলে সবুজ আলো জ্বলবে। একইসঙ্গে লাল এবং সবুজ রঙের দু’টি বড় বড় পতাকা ক্লাব প্রাঙ্গণের জলের একদম ধারে বসানো থাকবে। যদি কোনও শিক্ষার্থী দূর থেকে আলো না দেখতে পান, তাহলে এই লাল এবং সবুজ পতাকা দেখে বুঝতে পারবেন আবহাওয়া কী অবস্থায় রয়েছে। সেইমতো ওই শিক্ষার্থী নৌকা নিয়ে ফিরে আসবেন ক্লাবে।
সম্প্রতি রবীন্দ্র সরোবর পরিদর্শনে যান কেএমডিএ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পুলিশের আধিকারিকরা। রোয়ারদের নিরাপত্তার জন্য উদ্ধারকারী বোট পেট্রোলচালিত হলে লেকের জলে দূষণ ছড়াবে কি না, তা মূলত পরীক্ষা করে দেখা হয়। রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী তথা কেএমডিএ’র চেয়ারম্যান ফিরহাদ হাকিম বলেন, “আমরা সবদিক বিচার বিবেচনা করেই মোটরচালিত উদ্ধারকারী নৌকা নামানোর নির্দেশ দিয়েছি। তবে বেশ কিছু শর্ত আরোপ করে দিয়েছি। সেই কঠোর বিধি মেনে চলতে হবে। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষাবিধির সঙ্গে কোনও আপোস করা হবে না বলে আমরা ক্লাবকে জানিয়ে দিয়েছি।”
ইতিমধ্যে বোট চালানোর আগে জলের নমুনা সংগ্রহ করেছে কেএমডিএ এবং রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। আবার বোট চালানোর পর সেই জলের নমুনা নেন আধিকারিকরা। দু’রকম জলের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যায় জলে কোনওরকম দূষণ হচ্ছে না। জলের স্বচ্ছতা এবং যাবতীয় মাছ এবং অন্যান্য জীবেরও ক্ষতি হচ্ছে না। এরপরই মোটরচালিত উদ্ধারকারী বোট বা রেসকিউ বোট নামানোর অনুমতি আসে কেএমডিএ’র তরফে।
রোয়ারদের নিরাপত্তায় আপাতত ‘ম্যানুয়েল রেস্কিউ বোট’ রাখছে তিনটি ক্লাব। পাশাপাশি, রোয়িং চলাকালীন ক্লাব প্রাঙ্গণে থাকছে অ্যাম্বুলেন্স। প্রতিটি বোটে লেখা থাকছে অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর, প্রশিক্ষকের নাম ও নম্বর, সংশ্লিষ্ট ক্লাবের নম্বর। ক্লাব কর্তারা জানিয়েছেন, এই উদ্ধারকারী নৌকার ভিতর একটি হুটার লাগানো থাকবে। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া বা যে কোনও বিপর্যয়ে এই হুটার শিক্ষার্থীদের সতর্ক করবে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের জন্য যাবতীয় সুরক্ষা বিধির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
রাজ্যের রোয়িং অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তথা লেক ক্লাবের অন্যতম কর্তা শুভাশিস দাশগুপ্ত বলেন, “আমরা শিক্ষার্থীদের সুরক্ষাবিধির ব্যাপারে সবকিছুই আরোপ করেছি। কলকাতা পুলিশ এবং প্রশাসনের তরফে যা যা নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে তা প্রতিটি ছত্রে ছত্রে পালন করা হবে। যে ঘটনা ঘটেছে গত পাঁচ মাস আগে, তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু ইতিহাসে এরকম ঘটনা কখনও ঘটেনি রবীন্দ্র সরোবরে। তাই আমরা সুরক্ষা বিধির ক্ষেত্রে কোন ফাঁক ফোকর রাখতে নারাজ।”