ঢাকা: চৌধুরীপাড়া। চক্রবর্তীপাড়া। শেখপাড়া। এইসব পাড়ার কথা বললেই কোনও এলাকার একটি নির্দিষ্ট জায়গাকে বোঝা যায়। আশপাশের লোকেরাও এভাবেই চেনে ওই পাড়াগুলিকে। কিন্তু, বেগমপাড়ার নাম শুনেছেন? নামটা শুনে কি মনে হচ্ছে, ভারত কিংবা প্রতিবেশী কোনও দেশের এলাকা? এরকম ভাবলে ভুল করছেন। নামের সঙ্গে অবশ্য আমাদের প্রতিবেশী বাংলাদেশের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু, বেগমপাড়া রয়েছে কানাডায়। কী এই বেগমপাড়া? বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর কেন হঠাৎ এই বেগমপাড়া নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়েছে?
বেগমপাড়া নিয়ে আলোচনার আগে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি একটু খোলসা করা যাক। জুলাই মাসের শুরু থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উত্তপ্ত হতে শুরু করেছিল পদ্মাপারের দেশ। দেশজুড়ে আন্দোলনে নামেন পড়ুয়ারা। আর এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই সংঘর্ষে ৫০০-র বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গত ৫ অগস্ট প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। তারপর বাংলাদেশে ছেড়ে ভারতে আসেন। বাংলাদেশে এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আবার বেগমপাড়া নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে।
কী এই বেগমপাড়া?
বাংলাদেশে নয়। বেগমপাড়া রয়েছে কানাডার টরেন্টোতে। তবে বেগমপাড়া কানাডার কোনও এলাকার নাম নয়। বিত্তশালী বাংলাদেশি নাগরিকরা সেখানে বাড়ি কিনেছেন। আর ওইসব বিলাসবহুল বাড়িতে বাংলাদেশি ওই নাগরিকদের স্ত্রী ও সন্তানরা থাকেন। সেজন্য এর নাম বেগমপাড়া। মূলত রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মচারীরা সেখানে বাড়ি কিনেছেন। অবৈধ উপায়ে উপার্জনের টাকা সেখানে পাচার করা হয় বলে অভিযোগ।
বেগমপাড়ার সূত্রপাত-
তথ্য বলছে, কানাডায় ব্যাপকহারে অভিবাসন প্রথম শুরু হয় ২০০৬-০৭ সালে। বাংলাদেশে তখন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতি বিরোধী অভিযান শুরু করেছে। আর সেই সময় বাংলাদেশের একাংশ ব্যবসায়ী কানাডায় যান। সেখানে বিলাসবহুল বাড়ি কেনেন। তারপর ক্রমশ টরেন্টোয় বাংলাদেশি নাগরিকদের বাড়ি কেনার হিড়িক বাড়ে। অভিযোগ, অবৈধ উপায়ে উপার্জিত অর্থ রাখার জন্যই এই বাড়িগুলি কেনা হয়। জানা গিয়েছে, এইরকম বিলাসবহুল বাড়ির দাম কোনটা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১০ কোটি টাকা। আবার কোনটা ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা।
২০১০ সালে ভারতীয় পরিচালক রশ্মি লাম্বা একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করেন। বেগমপুরা: দ্য ওয়াইভস কলোনি। সেই সিনেমায় স্বামীদের অনুপস্থিতিতে স্ত্রীদের নিঃসঙ্গ জীবন তুলে ধরেন তিনি। যেখানে দেখানো হয়, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তানের ইঞ্জিনিয়াররা আরব দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে উচ্চ বেতনে কাজ করেন। একসময় সপরিবারে তাঁরা কানাডা আসেন। কিন্তু, কানাডায় যথাযথ কাজ না পেয়ে ফিরে যান আরব দুনিয়ায়। আর তাঁদের স্ত্রীরা থেকে যান কানাডায়। স্ত্রীদের নিঃসঙ্গ জীবনকেই তুলে ধরেছিলেন পরিচালক। কিন্তু, বেগমপাড়ার কথা প্রথম বলেছিলেন কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলি সাগর। বেগমপাড়ায় বাংলাদেশি নাগরিকরা দুর্নীতির টাকা দিয়ে বিলাসবহুল বাড়ি কিনছেন বলে উল্লেখ করেন। অনেক বাংলাদেশির কাছে এই বেগমপাড়া দ্বিতীয় বাড়ি।
বেগমপাড়া নিয়ে বাংলাদেশ প্রশাসন কি ব্যবস্থা নিয়েছে?
বেগমপাড়া নিয়ে একসময় শোরগোল পড়ার পর বাংলাদেশের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, রাজনীতিক নয়। বেগমপাড়ায় বাড়ি কেনার তালিকায় সবার আগে রয়েছেন বাংলাদেশের সরকারি কর্মীরা। তার এই মন্তব্যে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন অনেকে। বেতন ছাড়া একজন সরকারি কর্মচারীর অর্থ উপার্জনের আর কি উৎস? কোন উৎস থেকে অর্থ জমিয়ে বেগমপাড়ায় বিলাসবহুল বাড়ি কেনেন একজন সরকারি কর্মচারী? উঠে আসে দুর্নীতির প্রশ্ন।
বাংলাদেশের একটি দৈনিক সংবাদপত্র ‘দ্য ডেইলি স্টার’ এই নিয়ে আবদুল মোমেনের সঙ্গে কথা বলেছিল। সেইসময় আবদুল মোমেন বলেন, “আপনারা বারবার বেগমপাড়ার কথা বলেন। সেখানে নাকি বাংলাদেশিরা বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। বেসরকারিভাবে এই নিয়ে আমরা তথ্য সংগ্রহ করি। সেগুলো খতিয়ে দেখা হয়নি। এক প্রবাসী আমাদের কিছু তথ্য দিয়েছেন। সেই তথ্য দেখে আমরা হতবাক। আমরা ভেবেছিলাম, রাজনীতিকরা ওখানে বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন। কিন্তু, জানতে পারলাম, বেশিরভাগ বাড়ি কিনেছেন সরকারি কর্মীরা। তাঁদের মধ্যে অনেকেই অবসরপ্রাপ্ত। আবার অনেকেই এখনও কর্মরত। এছাড়া, ব্যবসায়ীরাও সেখানে বাড়ি কিনেছেন। তাঁদের সন্তানরা সেখানে থাকেন।”
সরকারি কর্মচারীরা কীভাবে বিদেশে বিলাসবহুল বাড়ি কিনলেন, সেই প্রশ্নের জবাবে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, “আমরাও জানি না কীভাবে এটা সম্ভব। হয়তো তাঁদের ক্রেডিট রেটিং খুবই ভাল। উত্তর আমেরিকার দেশগুলিতে ভাল ক্রেডিট রেটিং হলে অনেক ঋণ পাওয়া যায়। এভাবেই হয়তো তাঁরা বাড়ি কিনেছেন। আবার নগদ অর্থ দিয়েও বাড়ি কেনা যায়। আমরা পুরো তথ্য জানি না।”
কিন্তু, সরকারিভাবে কি কানাডা সরকারের কাছ থেকে এর তথ্য পাওয়া সম্ভব নয়? এই প্রশ্নের উত্তরে আবদুল মোমেনের জবাব ছিল, “তথ্য প্রকাশ করে না কানাডা সরকার। অভিযোগ ধরে ধরে যেতে হবে। কোনও নির্দিষ্ট বাড়ি সম্পর্কে যদি তথ্য জানতে চান, তবে ওয়েবসাইটে যেতে হবে। কানাডা সরকার কোনও তথ্য দেবে না।” তিনি আরও বলেন, আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি অনুসারে কোনও নাগরিক ব্যাঙ্কে লেনদেন করলে তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু, উত্তর আমেরিকার দেশগুলিতে পরিস্থিতি অন্যরকম। কোনও বাংলাদেশি নাগরিক সেখানকার ব্যাঙ্কে টাকা জমা করলে সেই তথ্য পাওয়া খুবই কঠিন।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার-
২০২০ সালে আমেরিকার অর্থপাচারবিরোধী সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি(জিএফআই) জানিয়েছিল, গত ৭ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাঁচ হাজার ২৭০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। যা বাংলাদেশের মুদ্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা। তাদের হিসেব মতো, প্রতি বছর গড়ে বাংলাদেশ থেকে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লক্ষ ডলার পাচার হয়। তবে ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১ হাজার ১৫১ কোটি ৩০ লক্ষ ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে।
খাটের তলায় টাকার পাহাড়। বাথরুমে লক্ষ লক্ষ টাকা। আমজনতা দেখেছে সেই ছবি। বাড়ি ছাড়িয়ে ভিন রাজ্যে হিসাব বহির্ভূত টাকা পাচারের কথাও শোনা যায়। আর বিদেশে অবৈধভাবে টাকা সঞ্চয়? সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে হিসাব বহির্ভূত টাকা রাখার তালিকাও ফাঁস হয়েছে। আর বাংলাদেশের একাংশ নাগরিকের হিসাব বহির্ভূত টাকা রাখার জন্য রয়েছে বেগমপাড়া। সেখানে রয়েছে বেগমও। কী হবে এই বেগমপাড়ার বিলাসবহুল বাড়ির মালিকদের? উত্তর ভবিষ্যতই দেবে।
আরও খবর পড়তে ডাউনলোড করুন Tv9 বাংলা অ্যাপ (Android/ iOs)