কলকাতা: প্রতিবাদ মিছিলের উদ্দেশ্য তিলোত্তমার ধর্ষণ-খুনের সুবিচার। আর সেখানেই কি না উঠল বিচ্ছিন্নতাবাদী স্লোগান! আরজি কর কাণ্ডে প্রতিবাদ চলাকালীন ভাইরাল হওয়া এই ভিডিও ঘিরে বিতর্কের সুনামি। ‘আজাদি’র স্লোগানে নতুন ঝড়। ৯ অগাস্ট থেকে বাংলার রাজপথে থেকে গলিপথ জাস্টিস ফর আরজি কর স্লোগানে আলোড়িত হয়েছে। তিলোত্তমার জন্য বিচার, ধর্ষকের শাস্তির দাবি, প্রতিবাদে এমন বহু স্লোগান উঠে এসেছে। এবার যাদপুরে উঠল ‘কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি’ স্লোগান! যা নিয়েই যত বিতর্ক। একদিন আগেই যাদবপুর চত্বরে বেরিয়েছিল একটি মিছিল। যেখানে শোনা গিয়েছিল এই স্লোগান। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই ব্যাপক চাপানউতোর চলছে রাজনৈতিক মহলে।
বছর আটেক আগের কথা। তখনও উঠেছিল আজাদির স্লোগান। তত্কালীন বাম ছাত্র নেতা কানহাইয়া কুমারের সুরে সুরে মিলিয়ে গলা ফাটিয়ে স্লোগান তুলেছিলেন আজাদি। ছাত্র সমাজের একটা অংশের কাছে সেই স্লোগান তখন মুখে মুখে ফিরছে। কেন আজাদির স্লোগান, তাঁর ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন কানহাইয়া। বলেছিলেন, দেশ থেকে আজাদি নয়। বরং দেশের মধ্যে থেকে, গরিবি, অপুষ্টি, পিতৃতন্ত্র থেকে মুক্তির কথা তাঁরা বলতে চেয়েছেন। জেএনইউয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা এবং বর্তমানে কংগ্রেস নেতা কানহাইয়া কুমারের আজাদির ডাক এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, তা পরে উঠে আসে গাল্লি বয়-এর মতো ছবিতেও। আজাদির সেই স্লোগানকে WRAP এ মিলিয়েছিলেন ডাব শর্মা।
কানহাইয়া কুমারকে আটক করা নিয়ে যখন দেশ উত্তাল, সেই সময়েই মুক্তি পেয়েছিল ডাব শর্মার আজাদি। কানহাইয়ার মুখের স্লোগান দিয়েই শুরু হয় সেটি। তার পরে তার সঙ্গে মিশে যায় WRAP। ২০১৬-তে সেই গানই নতুন করে উপস্থাপিত হয় ‘গাল্লি বয়’-এ। নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনে সেই আজাদির স্লোগান ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশেই। বিহারের পূর্ণিয়ায় কানহাইয়ার সভা থেকে দিল্লির ক্যাম্পাস বা কেরলের পালাক্কাড, সর্বত্র প্রতিরোধ এই সুরেই। কানহাইয়ার মুখ থেকে যে স্লোগান এত মুখে মুখে ফিরছে, সেই স্লোগান প্রথম কার মুখ থেকে বেরিয়েছিল? এখানেই সবার আগে উঠে আসছে কমলা ভাসিনের নাম।
এখানে প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক যে, কমলা কবে থেকে এই আজাদির স্লোগান দেওয়া শুরু করেন? কারও কারও মতে, এই স্লোগান ছাড়া আজ দেশের শুধু ছাত্র আন্দোলনই নয়, কোনও আন্দোলনই যেন সম্ভব নয়! বছর কয়েক আগে একটি সাক্ষাৎকারে কমলা ভাসিন বলেছিলেন, তিনি প্রথমবার এই আজাদির স্লোগান শোনেন গত শতাব্দীর আটের দশকে। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জিয়াউল হক। জিয়াউল সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলকে দেখা যায়নি। প্রথমে মহিলা সমাজকর্মীরাই তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে পথে নামেন। পাক ওই মহিলারা স্লোগান দিচ্ছিলেন, ‘অওরত কা নারা আজাদি/ বাচ্চোকা নারা আজাদি/ হাম লেকে রহেঙ্গে আজাদি/ হ্যায় প্যারা নারা আজাদি’। সেই সময় লাহোরে হাজির ছিলেন কমলা। এই স্লোগান তাঁর মনে গেঁথে যায়।
কমলার কথায়, ঘরভর্তি মহিলাদের সামনে এই স্লোগান সবাইকে মিলিয়ে দেয়। কমলা ভাসিন শুধুই তো মহিলাদের নিয়ে কাজ করেননি। তাঁদের আজাদির কথাই বলেননি। বরং, রাষ্ট্রপুঞ্জের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গত শতাব্দীর সাতের দশক থেকে নিজের সংগঠন বানিয়ে জড়িয়ে পড়েন সমাজসেবায়। কৃষকের জন্যই হোক অথবা শ্রমিকের। নারীরই হোক অথবা শিশুর। আদিবাসীর হোক অথবা দলিতের, কমলা ভাসিনের কণ্ঠ চিড়ে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়েছে ওই আজাদি স্লোগানে। আর এবার সেই স্লোগানের সঙ্গে ডুড়ে গেল কাশ্মীর মাঙ্গে আজাদি। ডাক্তারদের আন্দোলনে কেন এই স্লোগান তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
কমলার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সেই স্লোগান প্রথমবার দেশে কোথায় ব্যবহার হল? এখানেও বঙ্গ যোগ! সূত্রের খবর, ১৯৯১ যাদবপুরে উইমেন স্টাডিজের কনফারেন্সে শোনা গিয়েছিল ‘আজাদি’ স্লোগান। যাইহোক, দারিদ্র, বেকারত্ব থেকে আজাদির স্লোগান দিয়েছিলেন কমলা ভানিস। সেই স্লোগান জেএনইউ থেকে কলকাতায় জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে। এধরনের স্লোগানের জন্য কি আন্দোলন খেই হারিয়ে ফেলবে? বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন উত্তরটা দেবে সময়ই।