পার্থ চট্টোপাধ্যায়, শান্তি প্রসাদ সিনহা, সুবীরেশ ভট্টাচার্যরা গ্রেফতার হওয়ার পর নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় পরবর্তী নামটা যে মানিক ভট্টাচার্যের, তা মোটামুটিভাবে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বিশেষত ইডি-র মামলায় চার্জশিটে যেভাবে মানিকের সঙ্গে পার্থর কথোপকথনের উল্লেখ রয়েছে, তা প্রকাশ হওয়ার পরই পরিষ্কার হয়ে যায়, গোয়েন্দাদের নজর থেকে মানিকের নিস্তার পাওয়া কঠিন। অবশেষে ইডি-র জালে অধ্যাপক থেকে বিধায়ক হয়ে ওঠা মানিক।
ভট্টাচার্য পরিবারের অন্য কোনও সদস্য রাজনীতিতে তেমন সক্রিয় ছিলেন বলে জানা যায় না। মানিক নিজেও পিএইচডি করে অধ্যাপনা করতেন। পরে রাজনীতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ২০১১ সাল অর্থাৎ যে বছর রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় এল, সেই বছরই প্রথম নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মানিক ভট্টাচার্য। নদিয়ার পলাশিপাড়া থেকেই ভোটে লড়েছিলেন তিনি। কিন্তু সিপিএম প্রার্থী এসএম সাদির কাছে স্বল্প ফারাকে হেরে যান মানিক।
২০১৬-র প্রার্থী তালিকায় ছিল না মানিকের নাম। পরে ২০২১-এর ফের নির্বাচনে লড়েন সেই পলাশীপাড়া থেকেই। নাকাশিপাড়ার বাসিন্দা মানিক জয়ী হন পলাশীপাড়া থেকে।
নিয়োগ দুর্নীতিতে প্রথম থেকেই আঙুল উঠেছে তৃণমূল সরকারের দিকে। আর সেই তৃণমূল যে বছর ক্ষমতায় এসেছে, তার ঠিক পরের বছর থেকেই প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের দায়িত্ব পান মানিক। ২০১২ থেকে ২০২২ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় ১০ বছর এই গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন মানিক। পর্ষদের সবকিছুই যে তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা ছিল, তা বলাই যায়। পরে নিয়োগ দুর্নীতিতে নাম জড়ানোয় মানিককে সভাপতি পদ থেকে সরার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাইকোর্ট।
বিধানসভা কেন্দ্র পলাশিপাড়া হলেও সেখানে তাঁর বাড়ি নয়। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নদিয়ার নাকাশিপাড়ার ঘোরাইক্ষেত্র গ্রামে। বিধানসভা কেন্দ্রে তাঁকে খুব একটা দেখা যেত না বলেই জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। আর নাকাশিপাড়ার বাড়িও থাকত তালাবন্ধই। ৬৬ বছর বয়সি মানিকের জন্ম নাকাশিপাড়াতেই। পরে পড়াশোার সূত্রে বাইরে চলে যান তিনি ও তাঁর পরিবার। চার ভাইয়ের মধ্যে মানিক ভট্টাচার্যই বড়। বাকি তিন ভাইয়ের মধ্যে একজন প্রয়াত হয়েছে আগেই। বাকিরাও চাকরি সূত্রে জেলার বাইরে থাকেন। ওই বাড়ি বন্ধই থাকে সারা বছর। কখনও তাঁরা এলে, দরজা খোলা হয়।
তবে গ্রামের ছেলে বিধায়ক হওয়ায়, সমস্যার কথা বলতে দ্বিধা করতেন না প্রতিবেশীরা। এর প্রতিবেশী জানান, এলাকায় স্কুল, হাসপাতাল তৈরি হচ্ছিল মানিকের তত্ত্বাবধানেই। পুজোর সময়েও গ্রামে গিয়েছিলেন প্রাক্তন পর্ষদ সভাপতি। তখনও তাঁর সঙ্গে এই প্রতিবেশীর কথা হয়। তবে কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তাঁর কিছুই জানা নেই।
কর্মসূত্রে কলকাতাতেই থাকতেন, তাই নদিয়ার তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মানিকের খুব বেশি ঘনিষ্ঠতার কথা জানা যায় না। নদিয়ার আর এক বিধায়ক তথা তৃণমূল জেলা সভাপতি কল্লোল খাঁ আগেই জানিয়েছিলেন, বিধায়ক হওয়ার পর খুব বেশি আসেন না মানিক।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য নিয়ে স্নাতকোত্তর হওয়ার পর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছিলেন মানিক। পরে যোগেশ চন্দ্র চৌধুরী ল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। অবসরের পর পর্ষদ সভাপতি হিসেবেই দায়িত্ব সামলাতেন। কী ছিল তাঁর আয়? হলফনামায় নিজেকে পেনশনভোগী বলেই উল্লেখ করেছেন মানিক। সেইসঙ্গে পর্ষদ সভাপতি হিসেবে পেতেন সাম্মানিক। এ ছাড়া তাঁর একটি সিনিয়র সিটিজেন স্কিম করা ছিল, যা থেকে টাকা পেতেন।
হাইকোর্টের তরফেও আগে মানিকের সম্পত্তির হিসেব চাওয়া হয়েছিল। সেই হিসেব পেশও করেছিলেন তাঁর আইনজীবী। নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় মানিক জানিয়েছেন, যাদবপুরে তাঁর দুটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। রয়েছে ব্যাঙ্কে কিছু জমানো টাকা। অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়া তাঁর সম্পত্তির মূল্য ২ কোটি টাকার কিছু বেশি। আর দুই অ্যাপার্টমেন্টের মূল্য প্রায় ৬৬ লক্ষ টাকা। তাঁর বিরুদ্ধে নেই কোনও অপরাধের মামলা।