ফ্যাশন দুনিয়ায় (Fashion World) এক নজিরবিহীন ঘটনা। নাহ, বিদেশি বা আন্তর্জাতিক নয়, একেবারে খাঁটি ভারতীয় ফ্যাশনেই ঘটেছে ঐতিহাসিক ঘটনা। ভাবছেন, আবার কোন সেলেব আউটফিট নিয়ে ট্রোলড হলেন, কিংবা বলিউডের কোন তারকা এমন এক পোশাক পরে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন , যা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় তুলে দিয়েছে। এমন কোনও ঘটনার কথা এখানে বলা হচ্ছে না। প্রণব বক্সি (Model Pranav Bakhshi)। নাম একেবারেই আনকোড়া। ২১ বছরের এই যুবক ফ্যাশন মডেল অটিস্টিটকে (Autistic) আক্রান্ত। জীবনের সব প্রতিকূলতাকে জয় করে র্যাম্প কাঁপিয়ে দিয়ে সকলের চোখের মণি হয়ে গিয়েছেন এই প্রবাসী বাঙালি যুবক। অটিস্টিক প্রাইড দিবসে ( Autistic Pride Day) প্রণবের জীবনের এই উজ্জ্বল ও সফলের কথা সকলকেই অনুপ্রাণিত করবে, তা নিঃসন্দহে বলা যায়। মনের জেদ, ইচ্ছাশক্তির সিঁড়ি বেয়ে এখন তিনি নিজের লক্ষ্যে স্থির। ফ্যাশন দুনিয়ায় অটিজম নিয়ে নিজের কেরিয়ার গড়া কোনও সাধারণ ব্যাপার নয়। তাই এমন বীরকে স্যালুট জানানোই উচিত।
সাধারণত যে সব বাচ্চা ছোট থেকেই অটিজমে আক্রান্ত হোন, তাদের এক বিশেষ ও আলাদা প্রকার শিশু হিসেবে পরিচালনা করা হয়। আর পাঁচটা বাচ্চার মত তাদের জীবন অতিবাহিত হতে পারে না, সে কথা তাদের পদে পদে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই প্রচলিত চিন্তাধারায় নিজের ছেলেকে বয়ে যেতে দেননি প্রণবের মা-বাবা। মা একজন স্কুলশিক্ষিকা। তিনি নিজে মনে করেন, অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের কাছ থেকে প্রথমেই তাদের সব কৃতিত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। তারা যে পরনির্ভরশীল, তা পদে পদে বোঝানো হয়। বাস্তবের মাটিতে থেকে নিজের ছেলেকে অন্যান্য ছেলেদের মতই বড় করে তুলেছেন। নিজের পছন্দের প্যাশনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছেন প্রণবের অভিভাবকরা।
পড়াশোনা, ফিটনেস, ডায়েট, ফটোশ্যুট, র্যাম্পওয়াক, সমস্তকিছু একা হাতে সামলে চলেছেন এই মডেল। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে তাঁর দিন শুরু হ..। ফিটনেস সেশন শুরু হয় সকাল ৮টা থেকে। ওয়ার্কআউট রুটিনে থাকে কার্ডিও ও ওয়েট লিফ্টিং । তারপর ব্রেকফাস্টে প্রোটিন শেক খেয়ে গ্রাফিক ডিজাইন ক্লাসের জন্য বসে যাওয়া। দুপুরে চিকেন, ডাল, রোটি, বা রাজমা চাউল দিয়ে লাঞ্চ সেরে সন্ধ্যায় কফির সঙ্গে চাই ব্রোকলি, বেবিকর্ন জাতীয় স্ন্যাকস। চিট ডেতে চুটিয়ে পনির, পিত্জা, চাইনিজ খাবার খেতে পছন্দ করেন। জীবনের প্রত্যেকটি লক্ষ্যকে জয় করার জেদ রয়েছে তাঁর। পেশাদার জীবন থেকে অবসর নেওয়ার আগে তাঁর যে যে ইচ্ছে রয়েছে, তা পূরণ করার প্রচেষ্টা করে চলেছেন। শুধু কেরিয়ার গড়া নয়, সঙ্গে স্বপ্নগুলিকেও পাখনা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন। স্বপ্নগুলির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ মুম্বইয়ে একটি ইনডোর গল্ফ সিমুলেটর সেট, বিলিয়ার্ড রুম-সহ লাক্সারি ফ্ল্যাট। সঙ্গে একই ছাদের তলায় থাকবে ডিস্কো রুম ও সুইমিং পুলের ব্যবস্থাও।
২০১৯ সালে প্রথম ফ্যাশন দুনিয়ায় পা দেন প্রণব। মাত্র ১৯ বছর বয়সে একটি পোশাক ব্র্যান্ডে জন্য ফ্যাশন শোতে ওয়াক করেছিলেন। তারপর থেকেই শুরু। অটিজমে আক্রান্ত থাকায় প্রথম প্রথম র্যাম্পে হাঁটার ক্ষেত্রে অসুবিধা তৈরি হত। পরে ফ্যাশন কোরিওগ্রাফারদের সঙ্গে কথা বলে , তাদের শিক্ষাগুলিকে মনের মধ্যে গেঁথে নিয়ে হাঁটা শুরু করেন। সঙ্গীত, নাচ এইগুলিকে বেশ মনের কাছেই রেখে দেন। তবে এক টানা অনেকক্ষণ বসে থাকতে নারাজ প্রণব। তাই মেকআপের সময় তাঁকে বসিয়ে রাখা দুস্কর। এছাড়া ফটোগ্রাফিতে শখ রয়েছে তাঁর। প্রণবের এই জীবনধারা ও ভাললাগার বস্তুগুলি অন্য অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের কাছে অনুপ্রেরণায় হয়ে দাঁড়াবে। অটিজমে আক্রান্তনয়, তাঁকে একজন সফল মানুষ হিসেবে সকলে চিনবে, এটাই প্রণবের জীবনের লক্ষ্য। চলতি বছরের ল্য়াকমে ফ্যাশন শোয়ে ডিজাইনার আশিস সোনির শোয়ে তিনি হেঁটেছিলেন। তাঁর কথায়, আমি যখন নিজের বাধাকে অতিক্রম করে সফল হওয়ার লক্ষ্যে হেঁটে যাওয়ার চেষ্টাকরেছি, তখন আপনার আশেপাশের লোকজনও ঠিক সেইভাবেই আপনাকে দেখতে শুরু করবে। তাই অটিজম আক্রান্ত শিশুদের প্রতি স্নেহশীল অবশ্যই হবেন, কিন্ত তাদের স্বপ্নগুলিকে মাথা নত করতে দেবেন না । ওদের চাই আস্ত একটা পৃথিবী, আর সেই পৃথিবীকে জীবনের মধ্যে এনে গড়ে তোলাই বাবা-মায়েদের কাজ। প্রণবের ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে এমনটাই জানিয়েছেন তাঁর মা।