নীলাঞ্জন হাজরা: পর্ব ৭
মূল রেসিপি:
‘‘প্রথমেই এল বেক করা খানা, খুদে খুদে রসা-রসা পিসি মাছের ছানা। দুই নম্বর, হেক মাছ তাকে বলে, ডোবা গাঢ় ঝোলে। তিন নম্বরে এল টক-মিঠে খানা—জাফরানি, জটামাংসী, তগর, লবঙ্গ-দানা আর দারুচিনি, ছোট-ছোট ছাতু দেওয়া সাথে তার ভিনিগার আর ধোঁয়া-না-দেওয়া মধু এন্তার, মাঝখানে তার সোনালী গার্নার্ড এবং পারশে, তিন বিঘত-টাক চওড়া সে, ডিম ভরা, রাইজিন বন্দরে ধরা, আর ডেনটেক্স, কী যে সুন্দর, বড়সড়—তুলে নিয়ে আহা বাটি থেকে, চিবিয়ে-চিবিয়ে দাও খেয়ে নিতে, শুরুটা করতে দাও হে তারিয়ে, তারিয়ে তারিয়ে, চারটি পেয়ালা চিয়ান মদিরা পান করে নিয়ে, অঢেল সে রসে, মন যেন থাকে ভরা সন্তোষে! চতুর্থ পদে এল গ্রিল করা, পঞ্চম খানা এল ভাজা-ভাজা: মাঝখান থেকে কাটা চাকা চাকা; রেড মুলেট-ও তো (গোঁফ সহকারে) এল খান কয় বাটি ভরে-ভরে; গভীর থালায় দ্বিগুণ মাপের স্মেল্ট হাজির হয়; আর একখানা এল ফ্লাউন্ডার, খুব ভাল মতো গ্রিল তা করানো, ফিশ সস্ দিয়ে গভীরে ভেজান, মাথা থেকে লেজা শা-জিরে ছড়ান; এল শেষমেশ বড় একখান ভেটকির স্টেক, আহা বেশ বেশ, আহা বেশ বেশ।’’
—গরিব প্রোদ্রোমোস, কবিতা ৩
এমন বিচিত্র রেসিপি আর কখনও দেখেননি তো? আমিও না। আসলে রেসিপি তো ঠিক নয়, খানা-বর্ণনা। কিন্তু কার, কবেকার, কোথাকার—এই সব প্রশ্নের উত্তর যখন মিলবে তখন আমরা দেখব ওরেব্বাবা, এ শুধু রেসিপিও না, খানা-বর্ণনাও না, যেন একেবারে মহাবিদ্রোহ—নানা ভণ্ডামির গালে এক বিরাশি সিক্কার চড়, ক্ষুরধার স্যাটায়ারের মোড়কে। কিন্তু সে জন্য এ কব্তের গোটা প্রেক্ষিতটা জানা দরকার। তবেই রেঁধে মজা মিলবে, চেখেও। শুরু করা যাক ‘কোথাকার’ দিয়েই।
প্লেনটা যখন গাঢ় নীলের ওপর ভেসে থাকা তুষার-সাদা ঢেউ আর হরেক কিসিমের জলযানের ওপর কয়েক চক্কর দিয়ে গোঁৎ খেয়ে শহরটার দিকে ধেয়ে যাচ্ছিল, তার ঘুলঘুলি-জানালার টুকরো-দিয়ে-দেখা যে-ছবিটা আমার মনে আজও গেঁথে আছে তা এক বিশাল ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে থাকা সারি-সারি অদ্ভুত চিমনি। তার কোনওটা দিয়েই ধোঁয়া উড়ছিল না অবিশ্যি। উড়ছিল না এই কারণেই যে ওটা তো কারখানা নয়। এক বিপুল প্রাসাদের রান্নাঘর। দিন দুয়েক পরে যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমার যে অবস্থা হয়েছিল, তাকেই বলে ভ্যাবাচাকা খাওয়া। সে কথা সবিস্তারে বলব, এই সিরিজেই, কিন্তু যাকে বলে যথাস্থানে।
আপাতত এইটুকুই যে, ওই দৃশ্য দেখার কম সে কম পনের বছর পরে আমাদের আদ্যোপান্ত মধ্যবিত্ত রান্নাঘরে টেস্ট করার জন্য কড়াই থেকে এক চামচ ঝোল সুড়ুৎ করে মুখে টেনে নেওয়া মাত্র আমার ওই ছবিটার কথাই মনে পড়ল। কিন্তু ওই মনে পড়াটায় একটা ঐতিহাসিক গোলমাল আছে। ওই ছবি আর এই ঝোলের আশ্চর্য টক-মিষ্টি জাফরানি গন্ধে-ভরা মোলায়েম রেশমি স্বাদের মাঝখানে বয়ে গিয়েছে অন্তত আটশো বছর।
ইস্তানবুল। তোপকাপি প্রাসাদ। সেই প্রাসাদের হেঁশেল। কিন্তু এ রান্না যে রেসিপি থেকে নেওয়া, তা যখন লেখা হয়, তখন এই সুপ্রাচীন শহরের নাম ইস্তানবুল হয়ইনি। সে নাম তো হালফিলের। কিংবদন্তি আর ইতিহাস এ শহরের অলিতে গলিতে মিলে মিশে একাকার। ৬৫৭ পূর্বসাধারণাব্দে, মানে আজ থেকে ২৭০০ বছর আগে, এই শহর নাকি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গ্রিক শহর মেগারার কিংবদন্তি রাজা বাইজ়াস। নাম হল বাইজ়ান্টিয়ুম। ১৯৬ সাধারণাব্দে রোমান সম্রাট সেপ্টিমিয়ুস সেভেরুস সে শহর গুঁড়িয়ে দিয়ে ফের নয়া সাজে সাজিয়ে তার নাম দিলেন অগুস্তা আন্তোনাইনা, নিজের পুত্রের নামে। ৩৩০ সাধারণাব্দে নোভা রোমা, নব্য রোমান বা বাইজ়েন্টাইন সাম্রাজ্যের সম্রাট প্রথম কনস্টান্টাইন এ শহরকে রাজধানী করে নাম দিলেন নিজের নামেই—কনস্টান্টিনোপল। সেই থেকে প্রায় টানা ১৪৫২ সাল পর্যন্ত বাজ়ান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এই শহর। ১৪৫৩। প্রতিষ্ঠিত হল ‘দেভলেত-এ-আলি-এ-ওসমানিয়ে’, ওসমানিয়ে বা অটোমান সাম্রাজ্য। রাজধানী রয়েই গেল কনস্ট্যানটিনোপল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ওসমানিয়ে সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ সাফ করে ১৯২২ সালে প্রতিষ্ঠিত হল ‘তুর্কিয়ে চুমুরিয়েতি’, তুর্কি প্রজাতন্ত্র, যার রাজধানী হয়ে গেল আঙ্কারা। আর এই সেদিন, ১৯৩০-এ, তুরস্ক সরকার ডিক্রি জারি করে পরমাশ্চর্য এ শহরের নাম করে দিল ইস্তানবুল।
আমাদের এই স্বাদের কাহিনি ওসমানিয়ে নয় বাইজ়ান্টাইন দুনিয়ার। তখন কোমনেনোস বংশের শ্রেষ্ট সম্রাট দ্বিতীয় জন (রা. ১১১৮–১১৪৩) সিংহাসনে। তাঁর সভায় উঁকিঝুঁকি দিতেন এক বিচিত্র চরিত্র। কবি ও গদ্যকার। থিওডর প্রোদ্রোমোস। আনুমানিক ১১৬৬ সালে তিনি মারা যান। এই প্রোদ্রোমোসের জীবন নিয়ে জানা যায় সামান্যই। শুধু এইটুকুই যে, এক সময় বাইজ়ান্টাইন সম্রাটের দরবারে উঁকি-ঝুঁকি মারার সুযোগ পেলেও জীবনের কোনও এক পর্বে এসে তিনি সাংঘাতিক গরিব হয়ে পড়েন। অবস্থা এমনই হয় যে ভিক্ষে করে দিন গুজরানের মতো হাল। ইতিমধ্যে প্রয়াত হয়েছেন সম্রাট দ্বিতীয় জন, সিংহাসনে সম্রাট প্রথম মানুয়েল (রা. ১১৪৩–১১৮০)। ভদ্রলোকের হাল দেখে দয়া হল সম্রাটের। ব্যবস্থা করে দিলেন যাতে ফাইলোথেউ মঠে প্রোদ্রোমোস ‘নোভিস’, মানে বাংলায় বলা যায় ব্রহ্মচারী, হয়ে থাকতে পারেন—অন্তত মাথার ওপর ছাদ, গায়ের কাপড় আর দুবেলা দু’ মুঠো তো নিখরচায় জুটে যাবে। বলা যেতে পারে, আমাদের রেসিপিটি আসলে এই ফাইলোথেউ মঠেরই রেসিপি। সে কি মশাই, খানা খানদানিতে খামখা একটা মঠের রেসিপি কেন? এইটা বুঝতে হলে যে কবিতা থেকে এ লাইনগুলি নেওয়া সেটায় ঢুকতে হবে।
কিন্তু তার আবার একটা নিজস্ব কিস্সা আছে। কিস্সাটা এই যে, ঠিক এই সময়কালেই লেখা চারটি কবিতা পাওয়া গিয়েছে। শিরোনাম নেই। এক, দুই, তিন, চার—এই ভাবে চিহ্নিত করা। সাংঘাতিক ধারালো স্যাটায়ার, বাইজ়ান্টাইন সাধু গ্রিকে লেখা নয়, চলতি গ্রিকে, একেবারে পথ-চলতি গ্রিকে লেখা। চাঁছা ছোলা ভাষায়। এই কবিতাগুলো লিখেছেন কোনও এক ‘টোকোপ্রোদ্রোমোস’। গ্রিক খ্রিশ্চান ভাস্যে ‘টোকোস’ শব্দের অর্থ গরিব, কপর্দকশূন্য, ভিখিরি। কাজেই এ সব কবিতা লিখেছেন কোনও এক ‘গরিব প্রোদ্রোমোস’। এখন কথা হল, এই ‘গরিব প্রোদ্রোমোস’ আর থিওডর প্রোদ্রোমোস কি একই ব্যক্তি? পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে অধিকাংশের মতে দু’জনে একই মানুষ। কেন মনে করেন সে এক জটিল চর্চা। সে থাক।
তার থেকে অনেক রসের এই সব কবিতার বিষয়বস্তু। প্রথম কবিতায় নিজের মুখরা স্ত্রীর হাত থেকে রক্ষার জন্য সম্রাট দ্বিতীয় জনের কাছে আর্জি জানাচ্ছেন গরিব কবি! দ্বিতীয়টি, বাজ়ান্টাইনের মধ্যেই এক জমিদারকে সোজা বাংলায় যাকে বলে তেল দেওয়া, তাই করে নিজের অবস্থা একটু ভাল করতে সাহায্যের আবেদন। তৃতীয়টিতে সম্রাট প্রথম মানুয়েলকে জানাচ্ছেন কবি, মঠে কী সব কাণ্ডকারখানা চলে। চতুর্থ কবিতা লেখকের দুর্দশা নিয়েই। প্রত্যেকটিই চাবুক স্যাটায়ার।
এর মধ্যে আমাদের কারবার তৃতীয়টি নিয়ে। আমার মুশকিল হল আমি কোত্থাও কবিতাগুলির পূর্ণাঙ্গ ইংরেজি তরজমা খুঁজে পাইনি। সম্ভবত হয়েইনি। তবে খাপছাড়া-খাপছাড়া বেশ কিছু ইংরেজি তরজমা পাওয়া যায়, আর বহু লেখালিখি, যার মধ্যে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, গ্রিক-বাইজ়ান্টাইন সাহিত্যে সুপণ্ডিত মার্গারেট আলেক্সিউ-এর একটি প্রবন্ধে মেলে বহু কিছু। তৃতীয় এই কবিতার বেশ বিশদে আলোচনা করেছেন অধ্যাপক আলেক্সিউ, যার শিরোনাম ‘Poem III: A Darker Humour?’ দেখছি সম্রাট প্রথম মানুয়েল-কে কবি জানাচ্ছেন ‘নোভিস মঙ্ক’ আসলে ‘ছেঁড়া টেনা-পরা’! তাঁর কপালে জোটে অঢেল ধমকানি ও অন্যান্য অত্যাচার। অথচ ফাইলোথেউ মঠের হর্তাকর্তা সন্ন্যাসীদের জন্য আছে যা-কিছু সুখাদ্য ও আরামের সুব্যবস্থা কল্পনা করা সম্ভব। প্রসঙ্গত, এই ফাইলোথেউ মঠ কিন্তু মোটেই কাল্পনিক নয়। গ্রিসের আথোস পাহাড়ে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থোডক্স ক্যাথলিক মঠটি আজও বর্তমান। দশম শতকের শেষে এই মঠটি প্রতিষ্ঠিত হয়, মানে হাজার বছর প্রাচীন। গরিব প্রোদ্রোমোসের অভিযোগ, তাঁর সময়ে অন্তত, সে মঠের উঁচু পদের সন্ন্যাসীরা চান করতেন বাথটাবে, খেতেন সেরা সব মাছ আর পান করতেন সেরা সামিয়ান ও চিয়োত মদিরা। আর ওই ছেঁড়া টেনা-পরা ব্রহ্মচারীদের কপালে জুটত নোংরা মাটির ভাঁড়ে ‘পবিত্র ঝোল’!
উঁচু পদের সন্ন্যাসীদের পাতে পড়ে উপাদেয়তম মাছের স্ট্যু। আর বেচারা নোভিস মঙ্কদের খেতে হয় কুড়ি চাকা পেঁয়াজ, কয়েক টুকরো চিমড়ে পাঁউরুটি, আর সবুজ ছ্যাতলা-পড়া বিরাট কড়াই-ভরা জলে কয়েক ফোঁটা তেল-দেওয়া ঝোল! বর্ণনার পর ধারাল বর্ণনা চলতেই থাকে। আর তার পরেই আসে কবিতার ১৭৪ থেকে ১৯৪তম পঙ্ক্তি, যা অধ্যাপক আলেক্সিউয়ের মতে ‘প্রায় রেসিপিই বলা চলে’। আমরা পেয়ে যাচ্ছি একেবারে গোড়ায় উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলো।
কিন্তু এই বিচিত্র কবিতার হদিশ আমি অধ্যাপক আলেক্সিউয়ের প্রবন্ধ পড়ে পাইনি। পেয়েছি এক অসামান্য খানা-কেতাবে—Tastes of Byzantium: The Cuisine of a Legendary Empire। লেখক আমাদের পরিচিত—অ্যান্ড্রু ড্যালবি। ভাষাতাত্ত্বিক, লেখক, তরজমাকার, ইতিহাসকার। ও বহু ভাষাবিদ—ইংরেজি, গ্রিক, ল্যাটিন, হিন্দি, বার্মিজ, থাই ইত্যাদি।
একটু খুঁটিয়ে দেখলেই দেখা যাবে, ওই পঙ্ক্তিগুলিতে একটি নয় আসলে ছ’-ছ’টি রেসিপির সার সংক্ষেপ আছে—বেক-করা, গাঢ় ঝোলে-ডোবা, সুইট অ্যান্ড সাওয়ার এবং গ্রিল-করা, ভাজা এবং স্টেক। প্রত্যেকটিই মাছের রেসিপি। হরেক কিসিমের মাছ। সেরা মাছ, সেরা পাকপ্রণালীতে পাকান, সেরা স্বাদ, পাতে পড়ে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ মঠের উচ্চতম পদে আসীন সন্ন্যাসীদের। রাজ-খানার থেকে তা কম কিসে। খানদানি তো বটেই।
সবই তো বুঝলুম, কিন্তু বাইজ়ান্টাইনে পারশে? আজ্ঞে। চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করে নিজের হেঁশেলেই রেঁধে ফেলতে কাল পড়ে নিন শেষ অংশটা।
খানা-খানদানি প্রকাশিত হবে প্রতি মাসের দ্বিতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে শনিবার-রবিবার