১৯৭৪ সালের গ্রীষ্ম। টগবগে যুবক সরফুদ্দিন সিদ্দিকির বিয়ের রাত। রাতের খানার পর বছর ২৬-এর যুবকের হাতে এক বয়স্ক ব্যক্তি তুলে দিলেন একটা পান। সেই পানে ঠাসা ছিল সুপারি, মৌরি, লবঙ্গ এবং গুলকন্দ সহ আরও কিছু উপাদান! পানের উপর ছিল একটা লাল গোলাপের পাপড়িও। পান চিবোতে চিবোতে কয়েকটা উপাদান চিনলেও বাকিগুলো কেমন অচেনা লাগছিল কি! ‘পান খেয়ে ভারী ভালো লাগল। আমি আরও একটা পান চাইলাম।’ তারপর রাতে যেটা হল সেটা সর্বসমক্ষে না বলাই ভাল। ‘আমাদের দোকানেও ওই পান বিক্রি করা মনস্থির করলাম’— জানাচ্ছিলেন বছর চুয়াত্তরের সরিফুদ্দিন।
দোকানের তৎকালীন নাম ছিল ‘তারা পান সেন্টার’। তবে সরিফুদ্দিন পানের মাহাত্ম্য টের পাওয়ার পরেই দেরি না করে দোকানের নাম বদলে দেন সবচাইতে সুন্দর এবং দামি হিরের নামে— ‘কোহিনুর পান’। সত্যিই হিরে! আজকের দিনে, কোহিনুর পানের দাম জানলে চোখ কপালে উঠবে। কড়কড়ে ৫ হাজার টাকা খরচ করলে তবেই মিলবে ওই পান! মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদের নতুন উসমানপাড়ায় ৫৫ বছর ধরে ওই পানের দোকান তার ঐতিহ্য ধরে রেখেছে!
বিয়ের রাতে যে পানটি সিদ্দিকি সাহেব উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন সেই পানটিই তাঁর জীবন বদলে দেয়। বংশপরম্পরায় ওই বিশেষ পানের প্রস্তুতি শেখেন সিদ্দিকি সাহেব। সিদ্দিকি সাহেবের আগে তার আগের প্রজন্ম এই পান তৈরি করা শিখেছিলেন এক হাকিমের কাছ থেকে। এই পান খেলে খাবার সহজেই হজম হয়, স্বাদেও অতুলনীয়। এমনিতে পান আমরা সকলেই খাই। বিশেষ করে গুরুপাক আহারের পরে এক খিলি পান মুখে দিলে তবেই যেন ভোজ সম্পূর্ণ হয়। সাধারণভাবে দোকানে একটি ভাল পানের দাম পড়ে গড়ে ১০ টাকা।
তাহলে কোহিনুর পানের এত দাম কেন? ‘সুফল আছে’— সাংবাদিকদের জানিয়েছেন সিদ্দিকি সাহেব। ‘ইসসে টাইমিং বঢ় যাতা হে!’— তিনি জানান। সিদ্দিকি সাহেব আরও বলেন খাঁটি সোনার তবকে মোড়া এই পানে থাকে ১২টি বিশেষ উপাদান। ওই উপাদানগুলি কামোদ্দীপক। একবার খেলে উত্তেজনা বজায় থাকে টানা দুই দিন! ১২ টি মহার্ঘ উপাদানে ঠাসা ওই পান একবার খেলে ম্যারাথন নিশ্চিত!
সবকটি উপাদান সম্পর্কে না জানলেও ছয়টি উপাদান নিয়ে মুখ খুলেছেন সিদ্দিকিজী। ‘জাফরান, অম্বর (এক ধরনের রজন), মধু, কস্তুরী (হরিণ-কস্তুরীর নির্যাস), গুলকন্দ এবং আগর— একটি বিশেষ ধরনের সুগন্ধি যা শুধুমাত্র আসামেই মেলে। প্রতি কেজি সুগন্ধির দাম ৩ লক্ষ টাকা। কোহিনুর পান মেলে জোড়ায়। ‘পুং পান’ এবং ‘স্ত্রী পান’। পুং পানে থাকে মধু, অম্বর, আগর এবং ভোজ্য সোনার পাতা। স্ত্রী পানে থাকে গুলকন্দ, মিষ্টি পান মশলা, এবং ‘একটি আরও বহেতরিন সুবাস!’
তবে সিদ্দিকি সাহেবের একটাই সতর্কবাণী— এই পান শুধুমাত্র বিবাহিত নারী এবং পুরুষ দম্পতির জন্য। তিনি আরও জানান নভেম্বর ও ফেব্রুয়ারিতে বিয়ের মরশুমে এই পানের চাহিদা থাকে তুঙ্গে! পানের বাক্সটিও ভারী চমৎকার। তিনটি আলাদা খাপ থাকে বাক্সে। দু’টি খাপে থাকে দু’টি পান। তৃতীয় খাপে থাকে খুশবুদার ঈত্বর বা আতরের ছোট্ট শিশি। পান সেবনের আনন্দ আরও বাড়িয়ে তোলে আতর। সিদ্দিকি সাহেবের অভিমত— ‘যাঁরা পানের প্রকৃত কদর করেন তাঁরা খুশবুরও সমঝদার!’
কিন্তু কে বিবাহিত আর কে নয় তা বোঝা যাবে কীভাবে?
‘সাধারণত বিয়েবাড়ি থেকেই অর্ডার আসে। তবে কেউ যদি মিথ্যে বলে এই পান কেনে তার কোনও সুরাহা নেই!’
এ পানের কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই? ‘ভেষজ নানা উপাদান দিয়ে তৈরি এই পান। কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তাছাড়া ৫৫ বছর ধরে এই পান বিক্রি করা হচ্ছে। শুধু ভালো খবরই মিলেছে গ্রাহকদের কাছ থেকে। গ্রাহকরা প্রতি বিবাহবার্ষিকীতে পান কিনতে ফিরে এসেছেন।’—উত্তর দিয়েছেন সিদ্দিকি সাহেব।