‘দুপুরের খামোখা খেয়াল/ভাঙা তাক পুরোনো দেয়াল…/খুঁজে পাওয়া বই জানতে চায়/বান্ধবী আছে কে কোথায়?’… ‘চন্দ্রবিন্দু’র গানের লিরিক্স নিশ্চয়ই শোনেননি ক্যান্ডি চ্যাং। তবে ‘বান্ধবী’র কথা ভাবিয়ে তুলেছিল তাকে। ‘ভাঙা তাক’-এর দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে হয়তো লিভার ফেলিওরে মৃত প্রিয় বান্ধবীর জন্য এক মন ‘দেয়াল’ লিখতে চেয়েছিলেন আমেরিকার নিউ অরলিন্সের বাসিন্দা ক্যান্ডি চ্যাং। ক্যান্ডি সারাক্ষণ ভাবতেন, তাঁর প্রিয় বান্ধবীর শেষ ইচ্ছে কী ছিল। জীবনের শেষ দিনগুলো ওই বান্ধবী কীভাবে কাটাতে চাইতেন। ক্যান্ডির মতো এমন চিন্তাভাবনা আমাদের অনেকের মনেই বাসা বাঁধে—বিশেষত যখন আমরা কোনও প্রিয়জন বা পরিচিত মানুষকে হারাই। যদিও আমাদের সকলের মনেই সুপ্ত ইচ্ছে থাকে যে, আমরা সকলেই মরে যাওয়ার আগে ঠিক কীভাবে বাঁচতে চাই, সেটা একবার হলেও ভাবি। তবে ক্যান্ডি তাঁর এই মনের ভাবনা প্রিয় বান্ধবীর মধ্যে আবদ্ধ রাখেনি। তাঁর মনে হয়েছিল, মৃত্যুর আগে কী করতে চায় মানুষ—এই প্রশ্নটা যদি বিশ্ব দরবারে রাখা যায়, তাহলে কেমন হবে। এই ভাবনা থেকেই ‘বিফোর আই ডাই’ (Before I Die) আজ এক গ্লোবাল আর্ট প্রজেক্ট তথা সেনসেশনে পরিণত হয়েছে।
অবশেষে ‘দুপুরের খামোখা খেয়াল’ ভেঙে ক্যান্ডি খুঁজে নেন দেওয়াল—নিউ অরলিন্স শহরের পরিত্যক্ত বাড়ির। সেখানেই দেওয়াল শূন্যস্থানের সঙ্গে সে লিখে আসে ‘বিফোর আই ডাই আই ওয়ান্ট টু…’। ক্যান্ডি যখন প্রথমবার এটি লিখেছিলেন, এই ‘শূন্যস্থান’ কখনও কেউ আদৌ পূরণ করবে বলে তিনি ভাবেননি। কিন্তু পরদিন দেওয়াল ভরে গেল মানুষের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, শেষ ইচ্ছেয়। আর আজ বিশ্বের ৬০টি দেশে ২৫টি ভাষায় প্রায় ৪০০-এর বেশি দেওয়ালে লেখা ‘বিফোর আই ডাই আই ওয়ান্ট টু…’।
‘বিফোর আই ডাই’ শুধু যে একটা আর্ট প্রজেক্ট, তা নয়। প্রতিনিয়ত হাজার-হাজার মানুষ তার জীবনের শেষ ইচ্ছে লিখে চলেছেন এই দেওয়ালে। আর সেই ইচ্ছেগুলোই এই প্রজেক্টের সবচেয়ে বড় পাওনা। দেওয়াল জুড়ে কত মানুষের আশা, প্রতীক্ষা, ভালবাসা, স্বপ্ন, উদ্যম ইচ্ছে। এগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে কখনও হেসে ফেলবেন, আবার কখনও চোখের কোণে জলও জমে উঠবে। আবার বাঁচার ইচ্ছেটাও বেড়ে যেতে পারে।
ঠিক যেমন ইজ়রায়েলের রাজধানী জেরুসালেমের দেওয়ালে একজন লিখেছেন মৃত্যুর আগে তিনি ভয় পাওয়া বন্ধ করতে চান। আবার ভার্জিনিয়ার দেওয়ালে লেখা, মৃত্যুর আগে মানসিক অবসাদ থেকে বেরিয়ে আসতে চান কেউ। ‘বার্নিং ম্যান ফেস্টিভ্যাল’-এর একজন লিখে গিয়েছেন, ‘মৃত্যুর আগে নিজের ত্বক নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে চাই’। ব্রুকলিনের একজনের শেষ ইচ্ছে, তাঁর সব ভুলগুলো যেন ঠিক হয়ে যায়। ভালবাসা আর আশাতেও উপচে পড়েছে বিশ্বের ‘বিফোর আই ডাই’ দেওয়ালগুলো। আর্জেন্টিনার দেওয়ালে লেখা, ‘পৃথিবীর শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি তাকে ভালবাসতে চাই’। চিকাগোর দেওয়ালে কেউ লিখে গিয়েছে, ‘তাকে খুঁজে পেয়ে চুম্বন করতে চাই শেষবারের জন্য’। আবার নিউ অরলিন্সের দেওয়ালে লেখা, ‘আবার ভালবাসাতে চাই বেপরোয়াভাবে’। আবার বেজিংয়ে কেউ মৃত্যুর আগে তাঁর সত্যিকারের ভালবাসা খুঁজে পেতে চান।
ভারতের হায়দরাবাদেও রয়েছে ‘বিফোর আই ডাই’ দেওয়াল। সেখানে মৃত্যুর আগে মোটরবাইকে করে গোটা ভারতবর্ষ ঘুরে দেখার ইচ্ছের কথা লিখেছেন কেউ। আবার কেউ চান, মৃত্যুর আগে শুধু মা-বাবার দেখভাল করতে। অন্যদিকে, কাজাখাস্তানের কারও ইচ্ছে, মৃত্যুর আগে পৃথিবী ঘুরে দেখবেন তিনি পায়ে হেঁটে। আবার নেভাডায় কেউ মৃত্যুর আগে এভারেস্ট আহরোণ শেষ করতে চান। দুবাইয়ের দেওয়ালে লেখা, ‘সেভ লাইভস’। মৃত্যুর আগে ওই ব্যক্তি মানুষের জীবন বাঁচাতে চান। মাদ্রিদে কেউ চান, শুধু সমাজ দেখতে। কেউ আবার বাচ্চাদের ভালবাসা ও স্বাধীনতার সঙ্গে কীভাবে বাঁচতে হয়, তা শিখিয়ে দিয়ে যেতে চান।
এমন কত-শত ইচ্ছে রয়েছে মানুষের, যা তাঁরা মৃত্যুর আগে শেষ করতে চান। ৬০টি দেশে ৪০০টিরও বেশি দেওয়ালে হাজার-হাজার মানুষের শেষ ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষার উদাহরণ দিয়ে ক্যান্ডি লিখেছেন তাঁর বই ‘বিফোর আই ডাই’।
এই আত্মসর্বস্ব মুঠোফানের পৃথিবীতে যেখানে সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল, লাইকস, কমেন্টস, রিলস প্রতিমুহূর্তে গুলিয়ে দিতে চায় আমাদের ধৈর্য, সেখানে পৃথিবী জুড়ে অগুণতি, অসংখ্য মানুষ একের পর এক দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে স্থির হয়ে একমনে ভাবছেন, মরে যাওয়ার আগে ঠিক কীভাবে বাঁচতে চাই… এ তো আসলে মৃত্যুর কথা ভাবা নয়… বরং মৃত্যুকে জয় করে জীবনের জয়গান গেয়ে ওঠা সমবেত কণ্ঠে। ‘ডিজিটাল কানেক্টিভিটি’র পৃথিবীতে এ যেন এক স্বতন্ত্র প্রার্থনাসঙ্গীত, যেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে নানাবিধ ভাষার মানুষ গাইছেন একটাই গান: ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো. সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও’।