যুগ যুগ ধরে নিজস্ব ঐতিহ্য ও উজ্জ্বল দীপ্ত বজায় রেখে সকলের মন জয় করে চলেছে রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর। ঐতিহাসিক অতীতের শিকড় এখনও বর্তমান। আধুনিকীকরণের সঙ্গে ভারতের মূল ধারা কিন্তু এখনও চোখে পড়বে ছত্রে ছত্রে।
আম্বারের প্রাণবন্ত ও সমৃদ্ধ রাজ্যের পরে জয়পুর রাজ্য গঠিত হয়েছিল। রহিন শহরটি মহারাজা জয় সিং প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৭২৭ সালে সওয়াই জয় সিং নামে তিনি পরিচিত ছিলেন। জয়পুর যে একটি সুপরিকল্পিত শহর তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কারণ এই শহরের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন বিখ্যাত গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদ। এছাড়া সওয়াই জয় সিংকে শহরের স্থাপত্য নির্মাণে সহায়তা করেছিলেন বাংলার একজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বিদ্যাধর ভট্টাচার্য। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, শহরের প্রধান স্থানগুলি-রাস্তা, চত্বর, প্রাসাদ এবং সীমানাগুলির দুর্গ গঠনের জন্য সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পনা কৌশল তৈরি হতে ৪ বছর সময় লেগেছিল। এবং তাই নয়, প্রতিটি বাস্তুশাস্ত্রের কৌশলগুলিকে মাথায় রেখে তৈরি করা হয়েছিল এই সুন্দর সাজানো শহর।
১৭৯০ সালে পাঠানের যুদ্ধে মারাঠাদের বিরুদ্ধে রাজা হেরে গেলেও এর পৃষ্ঠপোষকতা বহন করার মতো যথেষ্ট সম্পদ ছিল। সওয়াই জয় সিং-এর পরে, আসেন ঈশ্বরী সিং, তার পরে কাচওয়াহা রাজবংশের বিভিন্ন শাসক। ১৯৪৯ সালে জয়পুর ভারতীয় ইউনিয়নের একটি অংশ হয়ে ওঠে। বর্তমানে, সওয়াই পদ্মনাভ সিং এবং তার রাজপরিবার জয়পুরের সিটি প্যালেসে বসবাস করেন।
জয়পুরকে কেন গোলাপী শহর বলা হয়?
১৮৭৬ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস এবং রানী ভিক্টোরিয়া ভারত সফরে আসার কথা ছিল। তাঁদেরকে স্বাগত জানাতে ‘পাধারো মাহেরে দেশ’ – এর সারমর্ম জীবন্ত করে তুলতে মহারাজা গোটা শহরকে টেরাকোটা গোলাপী রঙে সাজিয়ে তুলেছিলেন। আজও জয়পুরের ঐতিহাসিক গেট ও স্কোয়ারগুলিতে আতিথেয়তার রঙ হিসেবে গোলাপী রঙ ধারণ করে থাকে। জয়পুরের ইতিহাসে নিজেকে বুনতে পারদর্শী এই গোলাপী শহর।
পরবর্তীকালে জয় সিংকে সিংহাসন থেকে অপসারণের দাবি তোলেন আজম শাহ। মুঘলদের মিত্রের সঙ্গে জয় সিং নিজেকে আবার ক্ষমতায় নিয়ে আসেন। তার শাসনকালে এই রাজ্যের চরম বিকাশ লাভ করে এবং জয় সিং আম্বার দূর্গের চারপাশে তাঁর রাজধানী তৈরি করেন। ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শহর হিসেবে গড়ে তুলতে বাংলার প্রধান স্থপতি বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের সাহায্য় নিয়ে হয় জয়পুরকে। ভারতীয় স্থাপত্যের বিজ্ঞান নীতি অনুসরণ করে এবং জ্যোতির্বিদ্যার উপর প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানের উল্লেখ করে, জয় সিংয়ের সাথে পরিকল্পনাটি আরও বিকাশ ও আলোচনা করেন বিদ্যাধর ভট্টাচার্য। বলা হয়, ১৭২৭ সালে ১৮ নভেম্বর জয় সিং নিজেই শহরটির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
১৭৪৪ সালে মহারাজা জয় সিংয়ের মৃত্যুর পরয়, তাঁর পুত্ররা ক্ষমতার জন্য লড়াইয়ে উন্মুত্ত হয়ে উঠেছিল। কোনও রাজা ছাড়াই শহরটি প্রতিবেশী রাজ্যগুলির অনুপ্রবেশের জন্য উন্মুক্ত হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিল। পরবর্তীকালে রাজপুত ও মারাঠারা জয়পুরের অধিকাংশ দখল করে নেয়। ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলসকে শহরে স্বাগত জানাতে মহারাজা রাম সিং শহরটিকে গোলাপী রঙে সাজিয়ে তুলেছিলেন। আর এইভাবেই শহরের আরেক নাম পিংক সিটি বা গোলাপী শহর নামে পরিচিত হয়েছিলেন। ১৯২২ সালে দ্বিতীয় মান সিং সিংহাসন দখল করলে তিনি শহরে স্কুল, হাসপাতালের মতো প্রতিষ্ঠান তৈরি করেন। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর যোধপুর, জয়সালমীর এবং বিকানেরের সঙ্গে এক হয়ে ভারতের বৃহত্তম রাজ্য জয়পুর ও রাজস্থানের রাজধানী হিসেবে গড়ে ওঠে।