প্রতিবছরের মতো এবারেও পরীতে রথযাত্রা উত্সব অনুষ্ঠিত হবে। করোনা বিধি-নিয়ম মেনেই ২০২১ সালের আষাঢ় মাসে হিন্দুদের অন্যতম জনপ্রিয় উত্সব পালিত হবে। ভারতে ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গে এই রথযাত্রা ঘিরে আলাদা উদ্দীপনা রয়েছে। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর কৃষ্ণের বৃন্দাবন প্রত্যাবর্তনের স্মরণে এই রথযাত্রার আয়োজন করা হয়। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রাই ভারতের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ।
হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, আষাঢ় মাসের শুক্লাপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে রথযাত্রা পালিত হয়। মোট ১১দিন ধরে জগন্নাথ-সুভদ্রা- বলরামকে উতসর্গ করে আরাধনা করা হয়। এই বিশেষ উত্সবকে ঘোষা যাত্রা বলে পরিচিত। পুরীতে রথ টানতে প্রতি বছর লক্ষাধিক পূণ্যার্থীর সমাগম হয়। এখানে তিন দেবতাকে গুণ্ডিচা মন্দিরে জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। পুরীর রথযাত্রা ঘিরে রয়েছে অনেক ইতিহাস।
পুরীর রথযাত্রার ইকিহাস ও বর্ণনা-রীতি নিয়ে কপিলা সংহিতা, ব্রহ্ম পুরাণ, পদ্ম পুরাণ ও স্কন্দ পুরাণে উল্লেখ পাওয়া যায়।
পুরীর রথ যাত্রা ২০২১- তাৎপর্য
প্রায় আনুমানিক সাতশো বছরের পুরনো পুরীর রথযাত্রা উৎসব। পুরীর জগন্নাথ মন্দির হল হিন্দুর চার ধামের মধ্যে অন্যতম। গুন্ডিয়া রথযাত্রার কথা বারবার পুরীর ইতিহাস ঘিরে আসে, শোনা যায়, তিনি একজন মহিলা। পুরাতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদদের মতে, এই গুণ্ডিচা আসলে রাজা ইন্দ্রদ্যুন্মের স্ত্রী। পুরীর এই রাজবংশ আজও বর্তমান। বংশপরম্পরায় রাজা উপাধিতে ভূষিত যাঁরা, তাঁদের হাত ধরেই পুরীর রথযাত্রায় পুষ্পাঞ্চলি প্রদান থেকে, সোনার ঝাড়ু ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।
আরও পড়ুন: Snana Purnima 2021: সারা বছর ভাগ্য সহায় রাখতে এই নিয়মগুলি আজ কঠোরভাবে মেনে চলুন
ওড়িশার প্রাচীন পুঁথি ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ অনুযায়ী সত্যযুগ থেকে চালু হয়েছে এই রথযাত্রা। সেই সময় ওড়িশার নাম ছিল মালব দেশ। সেই সময়কার রাজা ইন্দ্রদ্যুন্ম বিষ্ণুর মন্দির গড়ার স্বপ্ন পেয়েছিলেন। কিন্তু মন্দির কেমন ভাবে তৈরি হবে, তার নকসাই বা কেমন হবে তা নিয়ে তাঁর কোনও ধারণা ছিল না । ওড়িশার প্রাচীন পুঁথি ‘ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ’ বলা হয়েছে, মালবরাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত। কৃষ্ণ তাঁর ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের সম্মুখে আবিভূর্ত হয়ে পুরীর সমুদ্রতটে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তাঁর মূর্তি নির্মাণের আদেশ দেন। মূর্তিনির্মাণের জন্য রাজা একজন উপযুক্ত কাষ্ঠশিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন। তখন এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ শিল্পী তাঁর সামনে দাঁড়ান আর মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন চেয়ে নেন। সেই কাষ্ঠশিল্পী রাজাকে জানিয়ে দেন মূর্তি নির্মাণকালে কেউ যেন দরজা না খোলে। দরজা বন্ধ করে শুরু হয় মূর্তি নির্মাণের কাজ।
রথ বা রথের গুরুত্ব
রথের দিন প্রতিটি রথকে পঞ্চাশ গজ দড়িতে বেঁধে আলাদা আলাদা ভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় গুণ্ডিচাবাড়ি। রথ নির্মাণের জন্য কাঠের সংগ্রহ বসন্ত পঞ্চমীর দিন থেকেই শুরু হয়। রথের নির্মাণ অক্ষয় তৃতীয়া থেকে শুরু হয়। সেই কাঠ সংগ্রহ করা হয় মাঘ মাসের বসন্ত পঞ্চমী তিথিতে। আর সেই কাঠগুলি নির্দিষ্ট পরিমাণে কাটা শুরু হয় রামনবমী তিথি থেকে। রথগুলিতে অন্য কোনও ধাতু ব্যবহার করা হয় না। রথের পেরেকও তৈরি হয় কাঠ দিয়ে। ভগবান জগন্নাথ, ভগবান বলভদ্র এবং দেবী সুভদ্রা এই তিনটি দেবতাকে উত্সর্গীকৃত তিনটি রথ সম্পূর্ণ করতে প্রায় দুই মাস সময় লাগে। ভগবান জগন্নাথের জন্য যে রথ তৈরি করা হয়, তাকে নন্দীঘোষ বলে। এই রথের মোট ১৬টি চাকা। পুরো রথটি লাল-হলুদ কাপড়ে মোড়া হয়। বলরামের রথের নাম তালধ্বজ। সুভদ্রার রথের নাম দর্পদলন।
স্নানযাত্রা
প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রথম পূর্ণিমাতেই জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রার আয়োজন করা হয়। গর্ভগৃহ থেকে মূর্তি তুলে এনে স্নান মণ্ডপে তা স্থাপন করা হয়। সেখানেই সুগন্ধি জল দিয়ে স্নান করানো হয় জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে। স্নানের সঙ্গে সঙ্গে চলে মূর্তির সাজসজ্জা। ১০৮ ঘড়া জলে স্নানের পরই জ্বরে কাবু হয়ে পড়েন জগন্নাথদেব। ভগবান জগন্নাথকে ৩৫টি সোনার কলসি, ভগবান বলরামকে ২২টি সোনার কলস ও সুভদ্রাকে ১৮টি সোনার কলস দিয়ে স্নান করানোর রীতি রয়েছে। এইসময় গৃহবন্দি অবস্থায় থাকেন তিনি। রথ পর্যন্ত বিশ্রাম নেন। তাই সেই সময়টা ভক্তরা জগন্নাথ দেবের দর্শন পান না। এমনকী, এই কয়েকটা দিন তাঁর পুজোও হয় না।
আরও পড়ুন: এ বছরও ভক্ত ছাড়াই রথযাত্রা পালিত হবে পুরীতে, সাধারণের জন্য মন্দিরের দরজা খুলবে জুলাই মাসে!
রথযাত্রার দিন উল্লেখ্য পুজো-বিধি
আনসারী- স্নানযাত্রার পর অর্থাত পুর্ণিমার পরে কাঠের মূর্তিগুলি শোভাযাত্রার তারিখ অবধি গর্ভগৃহের একটি ঘরে রাখা হয়।
চেরা পাহারা- মন্দিরের সিংহদ্বারের উত্তর দিকে পাশাপাশি রেখে দেওয়া হয়। এদিন ওড়িশার রাজা সোনার হাতলের ঝাড়ু দিয়ে রথটি পরিষ্কার করেন, পথও পরিষ্কার করেন এবং চন্দন ছিটিয়ে দেন।
সুনা ভিসা- রথযাত্রা শেষে যখন নিজের বাড়িতে জগন্নাথ ফিরে আসেন, তখন নিয়ম মেনে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরামকে ফের নতুন পোশাক পরানো হয়। সুন্দর সাজে সজ্জিত করা হয়।
হেরা পঞ্চমী-এদিন ভগবান জগন্নাথের স্ত্রী দেবী লক্ষ্মীর এক অনুষ্ঠান ও পুজো করা হয়।
প্রসঙ্গত, রথযাত্রার সময় ডাহুকার গাওয়া ডাহুকা বলি গান গাওয়া হয়। এটি একধরণের স্থানীয় কবিতা বা আবৃতি। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই ডাহুকা বলি না আওড়ালে রথ চলাচল করে না। বনতি খেলোয়াড়রা বনতি খেলেন এইদিন। অর্থাত এইদিন জগন্নাথকে সন্তুষ্ট করতে বনতি নামক এক সম্প্রদায়ের লোকজন আগুনের গোলা নিয়ে কৌশল দেখান। যদিও এই সমস্ত অনুষ্ঠানগুলি জগন্নাথের ভক্তদের উত্সাহের জন্য পালন করা হয়।