প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে শঙ্করাচার্য জয়ন্তী (Shankaracharya Jayanti) পালন করা হয়। আজ সেই বিশেষ দিন। দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে আদি শঙ্করাচার্যর জন্মজয়ন্তী। আদি শঙ্কর, যিনি জগৎগুরু শঙ্করাচার্য নামেও পরিচিত। ভারতের উল্লেখযোগ্য ধর্মীয় নেতা এবং দার্শনিকদের মধ্যে একজন। তার শিক্ষার মূল কথা ছিল আত্ম ও ব্রহ্মের সম্মিলন। তার মতে ব্রহ্ম হলেন নির্গুণ। ভারতীয় দর্শনের অদ্বৈত বেদান্ত নামের শাখাটিকে তিনি সুসংহত রূপ দেন। তাঁর অনুরাগীদের কাছে আজকের দিনটির বিশেষ গুরুত্ব আছে।
আদি শঙ্কর অধুনা কেরল রাজ্যের কালাডি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি সারা ভারত পর্যটন করে অন্যান্য দার্শনিকদের সঙ্গে আলোচনা ও বিতর্কে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজের দার্শনিক মতটি প্রচার করেন। তিনি চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। এই মঠগুলি অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের ঐতিহাসিক বিকাশ, পুনর্জাগরণ ও প্রসারের জন্য বহুলাংশে দায়ী। শঙ্কর নিজে অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রধান প্রবক্তা হিসেবে খ্যাত। এছাড়া তিনি হিন্দু সন্ন্যাসীদের দশনামী সম্প্রদায় ও হিন্দুদের পূজার সন্মত নামক পদ্ধতির প্রবর্তক। সংস্কৃত ভাষায় লেখা আদি শঙ্করের রচনাবলির প্রধান লক্ষ্য ছিল অদ্বৈত তত্ত্বের প্রতিষ্ঠা। আদি শঙ্কর উপনিষদ্ ও ব্রহ্মসূত্র অবলম্বনে সন্ন্যাসের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি উপনিষদ্, ব্রহ্মসূত্র ও ভগবদ্গীতার ভাষ্যও রচনা করেন। এই সব বইতে তিনি তার প্রধান প্রতিপক্ষ মীমাংসা শাখার পাশাপাশি হিন্দু দর্শনের সাংখ্য শাখা ও বৌদ্ধ দর্শনের মতও খণ্ডন করেন।
ইতিহাস
৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে কেরালার কালাডিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শঙ্কর এক রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবার নাম ছিল শিবগুরু ও মায়ের নাম আর্যাম্বা। জানা যায়, শঙ্করের বাবা-মা অনেক দিন ধরেই নিঃসন্তান ছিলেন। তাই তারা ত্রিশূরের বৃষভচল শিবমন্দিরে পুত্রকামনা করে পূজা দেন। এরপর আর্দ্রা নক্ষত্রের বিশেষ তিথিতে শঙ্করের জন্ম হয়।শঙ্কর যখন খুব ছোট, তখন তার বাবা মারা যান। এই জন্য শঙ্করের উপনয়নে দেরি হয়। পরে তার মা উপনয়ন করান। শঙ্কর ছেলেবেলা থেকেই খুব বিদ্বান ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি চারটি বেদ আয়ত্ত্ব করে নেন। সাত বছর থেকে শঙ্কর সন্ন্যাস গ্রহণের দিকে ঝুঁকেছিলেন। কিন্তু তার মা তাকে অনুমতি দিতে চাইছিলেন না। শেষে তিনি খুব আশ্চর্যজনকভাবে মায়ের অনুমতি পান। কথিত আছে, একদিন তিনি পূর্ণা নদীতে স্নান করছিলেন। এমন সময় একটি কুমির তার পা কামড়ে ধরে। শঙ্করের মাও সেই সময় পূর্ণার তীরে উপস্থিত ছিলেন। তিনি মা-কে বলেন, মা যদি সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দেন, তাহলে কুমিরটি তার পা ছেড়ে দেবে। ছেলের প্রাণ বাঁচাতে মা তাকে সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি দিলেন। তার পর থেকে কোনওদিন পূর্ণা নদীতে কোনো কুমিরকে দেখা যায়নি। ১৬-৩২বছর বয়স থেকে শঙ্করাচার্য সারা দেশে ভ্রমণ করেছিলেন এবং বেদের মূলবার্তা ছড়িয়েছিলেন সারা দেশে।
আদি শঙ্করাচার্যের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উক্তি
তিনি বলেন যে , ব্রহ্মই হল একমাত্র সত্য – এই জগৎ ব্রহ্মময় । তাঁর মতে , ” সঠিক বিদ্যা না থাকার ফলে মানুষ ব্রহ্মকে বুঝতে পারে না ” । আত্মাই হল ব্রহ্ম । এই ব্রহ্ম নির্গুণ এবং আনন্দময় । কিন্তু ব্রহ্ম আবার পারমার্থিক দৃষ্টিতে ব্রহ্ম হলেও ব্যবহারিক দৃষ্টিতে ঈশ্বর বলে প্রতিভাত হয় । অবিদ্যা ব্রহ্মের শক্তিবিশেষ যার ফলে জীব নিজেকে ব্রহ্মের থেকে ভিন্ন মনে করে । প্রকৃতপক্ষে , জীবাত্মা ও পরমাত্মা অভিন্ন ।
– দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে জ্ঞানী ব্যক্তিকে অবশ্যই নিজের এবং অহং-নিজের মধ্যে বৈষম্য অনুশীলন করতে হবে। এর মাধ্যমেই একজন ব্যক্তি আনন্দে পূর্ণ হয়ে উঠবে, নিজেকে বিশুদ্ধ সত্তা, চেতনা এবং আনন্দ হিসাবে স্বীকৃতি দেবে।
– সম্পদ, মানুষ, সম্পর্ক এবং বন্ধু বা আপনার যৌবন নিয়ে গর্ব করবেন না। মুহূর্তের মধ্যে এই সব কিছু কেড়ে নেয় সময়। এই মায়াময় জগৎ ত্যাগ করে পরমকে জান ও লাভ কর।
– প্রতিটি জিনিস তার নিজস্ব প্রকৃতির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আমি সবসময় সুখ কামনা করি যা আমার আসল প্রকৃতি। আমার স্বভাব কখনোই আমার কাছে বোঝা নয়। সুখ আমার কাছে কখনই বোঝা নয়, যেখানে দুঃখ হয়।
– ইন্দ্রিয় এবং মনকে নিয়ন্ত্রণ করুন এবং হৃদয়ের মধ্যে উপস্থিত ভগবানকে দেখুন।