আকাশদীপ কর্মকার
আনন্দপ্রিয় ও রুচিশীল বাঙালির উত্সবের অভাব নেই। উত্সবের ধারাবাহিকতা বহনে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই রয়েছে। থাকবেও। অধিকাংশ উত্সবের প্রধান ও মুখ্য উদ্দেশ্য় হল দেবদেবীদের সম্মান প্রদর্শন ঠিক। এই রকম একটি জনপ্রিয় উত্সব হল সরস্বতীপুজো তথা বসন্তপঞ্চমী। পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, ত্রিপুরা, নেপাল, অসম, উত্তর প্রদেশ ও বাংলাদেশেও এই প্রথা ও পূজার প্রচলন রয়েছে। এই উত্সবের মুখ্য় বিষয় হল সরস্বতী আরাধনা ও পরের দিন শীতলষষ্ঠী পালন। শীতলষষ্ঠীর দিনে অনেক হিন্দু পরিবার অরন্ধন পালন করে ও কলাইসিদ্ধ ভক্ষণ সহকারে বিশেষ বিশেষ কিছু নিয়ম পালন করে থাকে। শাস্ত্রবিদি অনুযায়ী দেবী সরস্বতী পুজো মাঘ বা ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে করা হয়। এবার দেবী সরস্বতী সম্পর্কে পৌরাণিক ব্যাখ্যায় আসা যাক।
সরস্বতী মূলত বিদ্যা কথা সমস্ত জ্ঞান ও সৃষ্টির কারক। দেবীকে অনেকে ব্রহ্মার পত্নী বা মেয়ে বলে সম্বোধন করে। আবার অনেকে এমন বলে থাকে যে দেবীকে ব্রহ্মা সৃষ্টি করা সত্ত্বেও তার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাকে পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। সেই ক্ষণে তার চতুর্দিকে পরিভ্রমণ করতে থাকে ও চতুর্দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ হেতু ব্রহ্নার নাকি চারটি মস্তক। কিন্তু এই ব্যাখ্য়াটি অনেকে ভ্রান্ত বলে মনে করেন। পদ্মপুরাণ এ স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী সরস্বতী একজন নদীর দেবী ছিলেন। পুরাকালে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের মধ্যে একটি ভয়ানক যুদ্ধ হয়ছিল। এর থেকে ভাদবগ্নি নামক একটি সর্বগ্রাসী আগুনের জন্ম হয়। যেটা সমগ্র সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে সমর্থ ছিল। সেই সময় সমগ্র সৃষ্টিকে রক্ষা হেতু দেবী ব্রহ্মালোক ত্য়াগ করে ঋষি উত্তঙ্কের আশ্রমে আসেন। ভগবান শিবের অনুরোধে সরস্বতী নামক নদীতে রূপান্তরিত হয়ে সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হন। উক্ত আগুনকে নিমজ্জিত করেন।
আবার অনেক পণ্ডিত অন্য মন পোষণ করেন। তাঁদের মতে, ভগবান বিষ্ণুর নাভি থেকে একটি পদ্মফুল উত্পন্ন হয়। তার মধ্যে ভগবান ব্রহ্মার জন্ম হয়। বিষ্ণুর আদেশ অনুসারে ভগবান ব্রহ্মার উপর সমস্ত সৃষ্টি রচনার দায়িত্ব পড়ে। কথামত ব্রহ্মা সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড রচনা করেন। প্রকৃতি ও প্রকৃতির নিয়মও তৈরি করেন। কিন্তু প্রকৃতি ও সময় বিধানানুসারে স্বাধীন। এই নিয়ম বা সৃষ্টির কারকই হল দেবী সরস্বতী, যিনি স্বাধীন ও স্বয়ংসম্পূর্ণা। ব্রহ্মা এই সৃষ্টি রচনার পর দেবী সরস্বতী বা প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বা বিচলিত হয়ে পড়েন, যা নিয়ম বিরুদ্ধ। বিচলিত হওয়ার কারণে চিন্তায় তার পাঁচটি মস্তকের সৃষ্টি হয়। এই নিয়মবিরুদ্ধ আচরণের কারণে ভগবান শিব রুষ্ট হয়ে ব্রহ্মার পঞ্চম মাথাটি কেটে দেন ও অভিশাপ দেন, তিনি যেন মর্ত্যে কোনওদিন পূজো না পান।
বহুজনের বহুমত থাকলেও একটা কথা স্পষ্ট যে দেবী সরস্বতী বিদ্য়া ও জ্ঞানের কারক। যিনি ৬৮ কলায় পারদর্শী। দেবীর চারটি হাত। একটি হাতে জল, একটি হাতে জপমালা, একটি হাতে পুস্তক ও অন্য হাতে বীণা। এই প্রত্যেকটির ভিন্ন ভিন্ন অর্থ আছে। জল নির্মলতা বা শুদ্ধতার প্রতীক। পুস্তক বেদের কারক। জপমালা মনসংযোগ ও আধ্য়াত্মিকতার কারক। বীণা সঙ্গীত বা ছন্দের কারক। দেবীর বাহন হংস বা হাঁস। বাহন অর্থে যিনি বহন করেন। হাঁস কেন বাহন?এটিরও ব্যাখ্য়া আছে। আসলে হাঁস এমন একটি প্রাণী যা জল-স্থল ও অন্তরীক্ষে গমন বা বিচরণ করে। আবার সমস্ত জ্ঞান ও সৃষ্টিতত্ত্বের কারক সরস্বতীর এই তিনটি প্রদেশেই বিচরণ আবশ্যক। তাই হিন্দুশাস্ত্রে হাঁসকেই দেবীর বাহন বলা হয়েছে। শুধু হিন্দুই নয়, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মও এই দেবীর পুজো বা আরাধনার উল্লেখ পাওয়া যায়। রামায়ণেও দেবী সরস্বতীর অবদানের কথা উল্লেখ আছে। রাবণের ভাই কুম্ভকর্ণ ব্রহ্মার কাছে বর প্রার্থনার সময় ইন্দ্রাসনের পরিবর্তে নিদ্রাসন চেয়ে বসেন। আসলে সৃষ্টিকর্তা হেতু বাগদেবী সরস্বতী কুম্ভকর্ণের মুখগহ্বরের অবস্থান করে তার বাক নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই যুদ্ধে রাবণ বধের পূর্বে কুম্ভকর্ণের বধ নিশ্চিত করে। তা না হলে পরিণতি ভয়ানক বা সত্য়ের জয় অসম্ভব হয়ে যেত। তাই রামায়ণে দেবী সরস্বতী ভবিষ্যতের সত্যের জয়কে ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
পৌরাণিক ব্যাখ্যা যাই হোক বা কেন, দেবী আসলে বৈদিক সৃষ্টি। কিন্তু বর্তমানে অন্যরূপে দেবীর আরাধনা করা হয়। বৈদিকযুগে তন্ত্রসিদ্ধি লাভের উদ্দেশ্যে নীলসরস্বতীর আরাধনার উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার পঞ্চমী তিথিতে অনেক তর্পণও করে থাকেন। দেবীকে কালি বা মহামায়ার একটি রূপ বলা হয়েছে। যা দেবীর প্রণাম মন্ত্রটি ব্য়াখ্যা করলেই জানা যায়। মন্ত্রটি হল…
ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বিদ্যাস্থানভ্যঃ এব চ স্বাহা।।
অর্থাত্ ভদ্রকালীকে (মঙ্গলদায়িকা ভগবতী) নিত্য নমস্কার। দেবী সরস্বতীকে পুনঃ পুনঃ নমস্কার ও বেদ-বেদান্ত-বেদান্তাদি-বিদ্য়াস্থানকে নমস্কার। দেবী সরস্বতীকে দুর্গার কন্যারূপেও ব্য়াখ্য়া করা হয়। যিনি দুর্গাপুজোর ময় দুর্গার সঙ্গেই পুজিত হোন।
উনবিংশ শতীব্দীতে চৌকির উপর তালপাতা, দোয়াত ও সর-কলম রেখে দেবীর আরাধনার প্রথা ছিল। পুজোর দিন বিদ্য়ার্থীরা সংস্কৃত, বাংলা গ্রন্থ ও স্লেট সহকারে পুজো করত। ইংরেজি ম্লেচ্ছ ভাষা হিসেবে বর্জনীয় ছিল। ওই দিনেই কচিকাঁচাদের পণ্ডিতের হাত দিয়ে হাতেখড়ি অর্থাত্ বিদ্য়ারম্ভের সূচনা হত। এই প্রথা আজও বাংলার কিছু কিছু ঘরে হয়। আধুনিক শিক্ষা ব্য়বস্থায় অভ্য়স্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি রাস্তার মোড়ে এই পুজো ধূম চোখে পড়ার মত। মূর্খ-জ্ঞান-উচ্চ-নীচ এমনকি অন্য় ধর্মের লোকও এই পুজোর মাধ্য়মে দেবী সরস্বতীকে সম্মান প্রদর্শন করেন। বিশেষ উল্লেখ্য যে বর্তমানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পুজো হলেও বর্ধমান বিশ্ববিদ্য়ালয় এই পুজো উপলক্ষে বিশেষ রীতি মেনে বহু বছর ধরেই তত্ত্ব আদান-প্রদানের মাধ্য়মে মহাসামরোহে পালন করে। আধুনিককালে একথা সত্য় যে সরস্বতী পুজোর দিনটি যেন বাঙালির ভ্যালেন্টাইন দিবস। নব যৌবনে পা রাখা কচিকাঁচারা যেন এই বিশেষ দিনটিকে ভালোভাবে উপভোগ করে। এটাও ঠিক যে বর্তমানে পুজোর চেয়ে আড়ম্বর অনেক বেশি হয়। কেন পুজো? কী কী রীতি? এগুলি যেন দিন দিন ব্রাত্য হয়ে গিয়েছে। করোনার করাল দৃষ্টি আমাদের মুহ্য়মান করলেও এই বিশেষ দিনে আমরা বাঙালিরা দেবীকে সম্মান জানাতে ভুলিনি। এবছরও ভুলব না। আনন্দ হৈ-হুল্লোড় ছিল, আছে ও থাকবেই। জয় সরস্বতী মাতার জয়।
আরও পড়ুন: Gods of Hinduism: স্রষ্টা হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুধর্মে ব্রহ্মার পুজো করা হয় না, কারণ জানলে শিউরে উঠবেন
(লেখক একজন জ্য়োতিষ ও গণিত গবেষক)