রোজকার ব্যস্ততার চাপে হোক, কিংবা রুটিনমাফিক জীবনযাপনের অভাব, খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের কারণে অজান্তেই শরীরে বাসা বাঁধছে বিভিন্ন রোগ। ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্সে কার্যত ঘেঁটে ফেলা দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ফাঁকে খেয়াল থাকে না ভাল-মন্দের। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ওজন। সঙ্গে মানসিক অবসাদ। বিগত ১০ বছর ধরে মানুষের শারীরবৃত্তিয় এই সমস্যাগুলি থেকে সমাধানের পথ দেখাচ্ছেন শাশ্বতী পাল সাহা।
শাশ্বতী পেশায় ডায়েটিশিয়ান। মাস্টার্স ও বিএড শেষ করার পরে কলকাতার একটি নামী হেলথ্ কেয়ার সংস্থায় ডায়েটিশিয়ান পদে ৭ বছর কাজ করেন তিনি। ক্লিনিকের বাইরে থাকা রোগীদের ভিড়ই বলে দিত শাশ্বতীর জনপ্রিয়তা। মসৃণভাবে চলা এই জীবনযাপনে হঠাৎই বাঁধ সাধে অতিমারি। ২০২০ সালে করোনার চোখরাঙানিতে গোটা বিশ্ব যখন উত্তাল, তখন সেই অনিশ্চয়তার রেশ পড়ে শাশ্বতীর জীবনেও। বাড়িতে একরত্তি শিশুকে রেখে, বাইরে বেরিয়ে কাজ করা তখন কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানকে ঘিরে চিন্তার কালো মেঘ বাড়তে থাকে শাশ্বতীর জীবনে। অবশেষে বন্ধ করতে হয় ক্লিনিকের কাজ।
আসলে অতিমারির সময়টা সকলের জীবনেই কালো অধ্যায় হিসাবে থেকে গিয়েছে। করোনার সময় মানুষ শুধুমাত্র ঘরবন্দিই হয়ে পড়েননি, সেই সঙ্গে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেই সময় বহু পুরনো রোগী শাশ্বতীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। প্রত্যেকের মুখে ছিল একটাই কথা— ‘নতুন কিছু শুরু করুন ম্যাডাম।’ কথাগুলো যেন ক্রমাগত শাশ্বতীর মাথায় ঘোরাফেরা করতে থাকে। সেই মতো মাঠেও নেমে পড়েন তিনি। সঙ্গে ছিল তাঁর স্বামীর সহযোগিতা। এই প্রসঙ্গে শাশ্বতী জানান, “সেই সময় আমার কাছে একটা বিষয় পরিষ্কার ছিল যে অতিমারি রুখতে গেলে মানুষের ইমিউনিটি তৈরি করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া সারাদিন বাড়িতে বসে থাকায় কম শারীরিক পরিশ্রমের ফলে বহু মানুষের শরীরে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধছে। ওজন বেড়ে যাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তখনই আমার মাথায় আসে অনলাইনের কথা। সেই সময় রোগীদের কাছে পৌঁছে যেতে অনলাইনের থেকে ভাল মাধ্যম কিছু হতে পারত না।”
সেই শুরু। তার পরে আর পিছনে ঘুরে তাকাতে হয়নি শাশ্বতীকে। ২০২১ সালে একটি ফেসবুক পেজ শুরু করেন শাশ্বতীকে। নাম দেন ‘হেলদি লাইফ উইদ শাশ্বতী।’ অতিমারির সময় শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন টিপস, ডায়েট সলিউশন ইত্যাদি পোস্ট করতে থাকেন সেই পেজটিতে। বিভিন্ন ভিডিয়ো ও পোস্টের মাধ্যমে এই বিষয়গুলি জানাতেন তিনি। ধীরে ধীরে মানুষ তা সাদরে গ্রহণ করেন। বাড়তে থাকে ফলোয়ার্স। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ শাশ্বতীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন ডায়েট সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শ নেওয়ার জন্য।
খুব অল্প সময়েই শাশ্বতী ফের ফিরে আসেন স্বমহিমায়। তাঁর দেওয়া পথ্যে উপকৃত হন বহু মানুষ। পরিসংখ্যাও দারুন। ইতিমধ্যেই প্রায় ৬০০০-এরও বেশি মানুষ যোগাযোগ করেছেন শাশ্বতীর সঙ্গে। দেশ পেরিয়ে বিদেশেও পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি খানিকটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। বলেন, “এত ভালবাসা আর এত পরিচিতি যে আমি পাব, তা আমি কখনই ভাবিনি।”
আসলে শাশ্বতীর এই সম্পূর্ণ যাত্রার নেপথ্যে রয়েছেন তাঁর মা — শিপ্রা পাল। শাশ্বতীর মা—ই শাশ্বতীর অনুপ্রেরণা। তাঁর থেকেই শাশ্বতী শিখেছেন কী ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়। তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করেই বহু মানুষের জীবন বদলে দিয়েছেন তিনি। শাশ্বতী নিজেও মা। তাই তিনি মাতৃস্নেহে রোগীদের পাশে দাঁড়ান। এ বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমিও একজন মা। যে ছোট শিশুকে সামলে কোভিডে ঘরবন্দি হয়ে মায়ের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে নিজের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি। যা আমাকে কখনও হারতে দেয়নি। আর আমার এই হার না মানা জেদের নেপথ্য নায়িকা আমার মা। তাঁর জন্যেই আমি আজ এতটা পথ অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছি।”
অনেক ছোট বয়সে বাবাকে হারান শাশ্বতী। মা শিপ্রা পাল তখন সংসার সামলাতেন। বহু কষ্ট করে তিনি বড় করেছেন শাশ্বতীকে। এত অনিশ্চয়তার মধ্যেও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন শাশ্বতী। ছোট থেকে মেধাবী ছিলেন তিনি। বড় হয়ে যে মানুষের পাশে দাঁড়াবেন, সেই স্বপ্নও ছোট থেকেই দেখতেন শাশ্বতী।
অতিমারি পর্ব কাটিয়ে বর্তমানে লেকটাউনে নিজস্ব চেম্বার রয়েছে শাশ্বতীর। অনলাইনের পাশাপাশি বহু মানুষ অফলাইনেও ভিজিট করেন। জীবনে চলার পথে শাশ্বতী আজ বহু মানুষের কাছে অণুপ্রেরণা। মা শিপ্রা পালও সগর্বে বলতে পারেন তাঁদের লড়াইয়ের কথা, ঘুরে দাঁড়ানোর কথা। সত্যিই তিনি রত্নগর্ভা। তবে, এখানেই শেষ নয়। শাশ্বতীর লক্ষ্য আরও বড়। জীবনের মঞ্চে আরও অনেকটা উঁচুতে যেতে চান তিনি। সঙ্গে সাধারণ মানুষের ভালবাসা তো রয়েছেই।
সদ্যোজাত মায়েদের জন্য বিশেষ কয়েকটি টিপস দিচ্ছেন শাশ্বতী —
সন্তানসম্ভবাদের জন্য শাশ্বতীর টিপস —