অভিষেক সেনগুপ্ত
নিউজিল্যান্ড ১৭২-৪ (২০ ওভারে)
অস্ট্রেলিয়া ১৭৩-২ (১৮.৫ ওভারে)
ছেলেবেলা থেকে স্টিভ ওয়া আর জ্যাক কালিসের অন্ধ ভক্ত। প্রথম জন চাপে পড়লে উজাড় করে দিতেন সেরাটা। আর দ্বিতীয় জন, বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ছেলেবেলা থেকে স্টিভ আর কালিসের মতো হতে চাইতেন। এতদিনে সেই স্বপ্নপূরণ হল মিচেল মার্শের। নিউজিল্যান্ডের প্রায় পকেটে ঢুকে যাওয়া ট্রফিটা একাই ছিনিয়ে নিলেন!
বাবা জিওফ মার্শের দেখানো পথেই হেঁটেছেন ছেলেবেলা থেকে। ১৯৮৭ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত ওয়ান ডে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। জিওফ মার্শ ছিলেন ওই টিমের নির্ভরযোগ্য ওপেনার। ১৯৯৯ সালে মার্শ পরিবার দ্বিতীয় বিশ্বকাপ দেখেছিল। জিওফ মার্শ ছিলেন প্রথম ওয়ান ডে বিশ্বকাপজয়ী অজি টিমের নির্ভরযোগ্য ওপেনার। ২২ বছর পর মার্শ পরিবারে ঢুকল তৃতীয় বিশ্বকাপ। কোনও ক্রিকেট পরিবারের বিশ্বকাপ জেতার হ্যাটট্রিক করার অভিজ্ঞতা খুব নেই!
কিছু ইনিংস থাকে ঘুরে ফিরে আসে বারবার। চিরকালীন আলোচনায় ঢুকে পড়ে। শান্তাকুমারন শ্রীসন্থের নেওয়া মিসবা উল হকের ক্যাচ। স্টুয়ার্ট ব্রডের এক ওভারে যুবরাজ সিংয়ের ৬টা ছয় মারা। ক্রেগ ব্রাথওয়েটের চার বলে চারটে ছয়। কুড়ি-বিশের বিশ্বকাপ নিয়ে এ বার আলোচনায় ঢুকে পড়বেন ৩০ বছরের এক অস্ট্রেলিয়ান। যিনি একাই অবলালীয় দেশকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে গেলেন।
? ????????? ? #T20WorldCup #T20WorldCupFinal pic.twitter.com/ip8vSnupO7
— T20 World Cup (@T20WorldCup) November 14, 2021
ছেলেবেলায় এএফএ ন্যাশনাল ফুটবল প্রেমে বিভোর ছিলেন। যাঁর বাবা জিওফ মার্শ, দাদা শন মার্শ। তিনি ক্রিকেট থেকে দূরে থাকবেন কী করে? ১৭ বছর বয়সে ক্লাব ক্রিকেটে পা দিয়েই আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। কে জানত, আর এক রত্নের জন্ম দেবে মার্শ পরিবার! কখনও জিততে না পারা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটা উপহার দেবেন অস্ট্রেলিয়াকে! কুড়ি-বিশের কেরিয়ারে এতদিন ৭৫ ছিল সর্বোচ্চ। তা ছাপিয়ে তো গেলেনই, ৫০ বলে নট আউট ৭৭ রানের সোনার ইনিংস খেলে গেলেন মিচেল। নিউজিল্যান্ড বোলিং তছনছ করে। কেন উইলিয়ামসনদের কাপ জেতার স্বপ্ন ভেঙেচুরে দিয়ে!
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৫৩ রানের ইনিংস খেলেছিলেন ক’দিন আগেই। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও খুচরো রান করে গিয়েছিলেন। তবু, মিচেল ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেন, কেউই ভাবেনি। এমনকি, ফাইনালেও। অজি অলরাউন্ডার ১ ওভার বল করলেও তেমন ছাপ রাখতে পারেননি। সেই তিনি তিন নম্বরে ম্যাচ উইনারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। ক্যআপ্টেন অ্যারন ফিঞ্চকে হারিয়ে তখন বেশ চাপে অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকেই ডেভিড ওয়ার্নারকে সঙ্গী করে দুরন্ত ব্যাট করে গেলেন। ওয়ার্নার ৫৩ করে আউট হয়ে গেলেও তাঁকে থামানো যায়নি। ৪টে ছয় ও ৬টা চার দিয়ে সাজিয়েছেন ইনিংস। শুরুতে ইশ সোধি, মিচেল স্যান্টনার কিছুটা চাপ তৈরি করেছিলেন ঠিকই, ওখান থেকেই পাল্টা আক্রমণের পথে হাঁটলেন ম্যাচের সেরা মিচেল। টি-টোয়েন্টিতে চলতি বছরটা যেন মিচেল মার্শের। ছ’টা হাফসেঞ্চুরি করেছেন সব মিলিয়ে। ৬টাই এসেছে এ বার।
ক্রিকেটে এক-একটা ম্যাচ যেন মহাকাব্য! বহু চরিত্রের মাঝে কেউ কখনও মুখ্য হয়ে ওঠেন, কখনও হারিয়ে যান। ওঠা-পড়ার খেলায়, আলো-অন্ধকারের খেলায় কে যে কখন বাজিমাত করবেন, বোঝাই যায় না। দুবাইয়ের কথাই ধরা যাক। প্রথম ইনিংসটা ধরলে, কেন উইলিয়ামসনের এই ফাইনাল যে আক্ষেপের রাত হয়ে উঠবে, তখন বোঝা গিয়েছিল? ৪৮ বলে ৮৫ রানের স্বভাববিরুদ্ধ, বিস্ফোরক এবং অবাক করা ইনিংস খেলেছিলেন। অবশ্য ২১ রানের মাথায় ডিপ স্কোয়্যার লেগে হ্যাজেলউড তাঁর ক্যাচটা না ফেললে গল্প আবার মোড় নিত। তার পর যেন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন উইলিয়ামসন। অস্ট্রেলিয়ান বোলিংকে রীতিমতো ছেলেখেলা করছিলেন যেন! এক হাতে ছয় মারছেন মিড উইকেট থেকে পয়েন্ট পর্যন্ত। উইলিয়ামসন ঝড়েই ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল ফিঞ্চদের পরিকল্পনা। ১৭২-৪ তুলে দিয়েছিলেন স্কোরবোর্ডে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ (T20 World Cup 2021) নিউজিল্যান্ডও কখনও জেতেনি। কিন্তু এই ফর্ম্যাটে যে কিউয়িরা অবিস্মরণীয় পারফর্ম করতে পারেন, সেটাই যেন প্রমাণ করতে নেমেছিলেন উইলিয়ামসন। তিনি না থাকলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের সবচেয়ে বেশি রান উঠত না।
ঠিক যেমন মিচেল মার্শ না থাকলে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করে জেতা হত না অস্ট্রেলিয়ার। ৭ বল বাকি থাকতেই ১৭৩-২ তুলে কিউয়িদের হারালেন অজিরা। মিচেলের বর্ণময় ইনিংসের পাশে নিউজিল্যান্ড বোলিং দাঁড়াতেই পারবে না!
অস্ট্রেলিয়া যেমন তারকাখচিত টিম, শৃঙ্খলাপরায়ণও। প্রতিভার সঙ্গে পরিশ্রমের একটা অদ্ভুত আঁতাত আছে। আর তার সঙ্গে যদি শৃঙ্খলা মিশে যায়, তা হলে যে কোনও স্বপ্নপূরণ করা যায়। আটের দশকের শেষ থেকে গত দশক পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ান টিম এই ফর্মুলাতেই দাপিয়ে বেড়িয়েছে ক্রিকেটে। আরও একবার সেটাই দেখা গেল। ৫বার ওয়ান ডে বিশ্বকাপ জয়, ২বার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সঙ্গে ঝলমল করবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটাও। টি-টোয়েন্টিতে চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া অদৃশ্য বার্তাটা কি পড়তে পারল ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডের মতো টিমগুলো? ১১ মাস পর অস্ট্রেলিয়াতেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। বাউন্সভরা সিডনি, পারথে অজিরা আরও একবার কাপ মুঠোতেই রাখার চেষ্টা করবে…! কে বলতে পারে, হয়তো আমিরশাহি থেকেই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অজি-আধিপত্য সূচনা করে দিলেন মিচেল মার্শরা!
সংক্ষিপ্ত স্কোর: নিউজিল্যান্ড ১৭২-৪ (উইলিয়ামসন ৮৫, গাপ্টিল ২৮, ফিলিপস ১৮, হ্যাজেলউড ৩-১৬, জাম্পা ১-২৬)। অস্ট্রেলিয়া ১৭৩-২ (মিচেল নট আউট৭৭, ওয়ার্নার ৫৩, ম্যাক্সওয়েল ২৮, বোল্ট ২-১৮)।