আলো আর অন্ধকার, দুই-ই পা মেলায় ইতিহাসের মিছিলে। উজ্জ্বলতম অতীত যেমন ফিরে আসে স্মৃতিতে, তেমনই চুপিসারে হানা দেয় কলঙ্কও। ক্রিকেট ইতিহাস যেমন রেকর্ড, সাফল্য, নায়কদের খোঁজ দেয়, তুলে ধরে বিতর্কিত ঘটনাও। ক্রিকেট ইতিহাসের মহাবিতর্কিত নানা গল্পের খোঁজ দিল TV9 Bangla। সঙ্ঘমিত্রা চক্রবর্তী তুলে ধরলেন ষষ্ঠ কিস্তি।
৫০ ছুঁই ছুঁই বার্নিস রবিনসন সেদিন কাজে পৌঁছেছিলেন একটু দেরিতেই। ঘড়ির কাটা তখন ছুয়েছে সাড়ে ন’টা। তেমন সময় জামাইকার পেগাসাস হোটেলে তড়িঘড়ি লিফ্টে করে বার্নিস উঠে পড়লেন ১২ তলায়। গিয়ে দাঁড়ালেন ৩৭৪ নম্বর রুমের সামনে। সেখান থেকে দরজায় টোকা দিলেন। কোনও সাড়াশব্দ পেলেন না। ফের সময় নিয়ে, আবার দরজায় কড়া নাড়লেন। নাহ!!! এ বারও ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ এল না। বার্নিস কী-কার্ড হাতে নিয়ে খুললেন সেই রুম। ঢুকেই দেখলেন ঘুটঘুটে অন্ধকার রুম। তখন তিনি ভেবে নিলেন, ভেতরে থাকা ব্যক্তি নির্ঘাত অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। তাই সেই রুমটা ছেড়ে তিনি চলে গেলেন অন্য রুমের কাজ সারতে।
তিন-চারটে রুম পরিষ্কার করে ফের এলেন ৩৭৪ রুমের সামনে। ফের দরজায় টোকা দিলেন। কিন্তু এ বারও কোনও উত্তর নেই। তিনি তারপর রুমে ঢুকে দেখলেন বিছানাটা খালি। তবে তার নজর আটকে যায় বিছানায় থাকা বালিশে। সেই বালিশের এক কোণায় লেগে ছিল রক্তের দাগ। এরপর তিনি সেই রুমের বাথরুমে উঁকি দেন। সেখান থেকে কোনও সাড়া শব্দ আসছিল না। বাথরুমের দরজা খুলতেই বার্নিসের চোখে পড়ে একটা ছয় ফুট লম্বা মানুষের নিথর দেহ পড়ে রয়েছে। সেই দেহটা ছিল বব উলমারের (Bob Woolmer)। বার্নিস ওই অবস্থায় উলমারকে বাথরুমে পড়ে থাকতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে এমার্জেন্সি অ্যালার্ম বাজিয়ে দেন। তড়িঘড়ি উলমারকে কিংস্টন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। ডাক্তার কুপার এবং ডাক্তার সিমিওন ফ্রেঞ্চ তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।
সালটা ছিল ২০০৭। বিশ্বকাপ চলছিল। টুর্নামেন্ট চলাকালীন ক্রিকেটবিশ্ব তোলপাড় করে দিয়েছিল বব উলমারের রহস্যমৃত্যু। ১৭ মার্চ নবাগত আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরেছিল পাকিস্তান। বিশ্বমঞ্চে আয়ারল্যান্ডের কাছে পাকিস্তানের লজ্জার হারের কয়েকঘণ্টার মধ্যেই পাক কোচ বব উলমারের মৃতদেহ উদ্ধার হয় টিম হোটেলে তাঁর রুমের বাথরুম থেকে। একরাশ হতাশা নিয়ে টিম হোটেলে ফিরেছিলেন উলমার। তারপর আর উলমারকে জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায়নি। ১৮ মার্চ পেগাসাস হোটেলকর্মী বার্নিস যখন ৩৭৪ নম্বর রুমের বাথরুমে উলমারকে পড়ে থাকতে দেখেন, সেই সময় নগ্ন অবস্থায়, পা মুড়িয়ে মেঝেতে পড়েছিলেন উলমার। তাঁর মুখে ছিল রক্তের দাগ। চারিদিক থেকে আসছিল বমির উটকো গন্ধ। দেওয়ালজুড়েও লেগেওছিল বমির দাগ। প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়েছিল, হতাশার কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
উলমারের মৃত্যু ঘিরে কম রহস্য ছিল না। বলা হয়, পাকিস্তান ক্রিকেটে জুয়াড়িদের যোগসাজশের ব্যপারে কোনও গোপন তথ্য জানতে পেরেছিলেন বব। এর জেরেই কি প্রাণ হারাতে হয়েছিল ববকে? উত্তর অজানা। বব উলমার সুস্থ ছিলেন না। সেই সময় টাইপ-টু ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন বব। আইরিশদের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপে অপ্রত্যাশিত হারের পর মুষড়ে পড়েছিলেন তিনি। হোটেলে ফিরেই তিনি সেখানকার বারেও যান। হতাশা ভুলতে গলা ভিজিয়েছিলেন মদের গ্লাসে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে মদ একেবারে বিষের সমান। ববের ক্ষেত্রেও কি সেটা হয়েছিল? এই প্রশ্নও উঠেছিল। উলমারের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যাও ছিল। একাধিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, হতাশা থেকেই অতিরিক্ত মদ্যপান করে বসেন উলমার। সেদিন তাঁর খুব কাশিও হচ্ছিল বলে জানিয়েছিল পাকিস্তানের টিম বাসের ড্রাইভার। সবমিলিয়ে কাশতে কাশতে শ্বাসকষ্ট হয়ে, দম আটকে যেতেই পারে উলমারের। পরবর্তীকালে ববের পরিবার মেনে নেয়, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণেই তিনি মারা গিয়েছেন। বব না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন ১৫ বছর আগে। তাঁর মৃত্যুরহস্যের কিন্তু কোনও কুলকিনারা হয়নি।