দীপঙ্কর ঘোষাল
পূর্বাঞ্চল থেকে এর আগে অনেকেই এসেছেন। কিন্তু ঘুরে ফিরে এসেছে সেই প্রসঙ্গ, বাঙালি কি আর দেখা যাবে না? দীর্ঘদিন পর সেই অভাব পূরণ করে দিলেন সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় ক্রিকেটে যখন বিরল প্রজাতি হয়ে যাচ্ছে বঙ্গসন্তান, ঠিক তখনই আর এক বাঙালির উত্থান দেখল বাংলা এবং ভারতীয় ক্রিকেট। তিনি বাংলার না হয়েও বাঙালির প্রতিনিধি। শনিবার বিকেলে বোর্ডের ক্রিকেট অ্যাডভাইসরি কমিটি বা সিএসি নতুন নির্বাচক ঘোষণা করে দিল। তাতে সেন্ট্রাল জ়োন থেকে জায়গা পেয়েছেন সুব্রত। তাঁকে যখন ফোনে ধরল TV9 Bangla, তখন তিনি মুম্বই থেকে পুনে যাচ্ছেন। বিমান ছাড়ার মুখে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বলে দিলেন, ‘খবরটা শুনেই মন ভালো হয়ে গিয়েছিল।’
কিছুদিন আগেও জাতীয় নির্বাচক পেয়েছে বাংলা। দেবাং গান্ধী ছিলেন জাতীয় নির্বাচক। তাঁর আগে রাজা ভেঙ্কট, অশোক মালহোত্রা, প্রণব রায়রা নির্বাচক মণ্ডলীতে এসেছেন। কিন্তু আপাদমস্তক বাঙালি যদি খুঁজতে হয়, ফিরে যেতে হয় সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ে। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ সাল— চার বছরের জন্য জাতীয় নির্বাচক ছিলেন সম্বরণ। তাঁর সময়েই, আরও ভালো করে বললে, ২৩ এপ্রিল দিল্লির তাজ প্যালেস হোটেলে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে ভারতীয় টিমে ঢুকিয়েছিলেন সম্বরণ। ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে মহারাজ প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, তিনি ইতিহাস গড়তে এসেছেন। দীর্ঘদিন পর বোর্ডের নির্বাচন কমিটিতে আবার এক বন্দ্যোপাধ্যায়। ইনি সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। ফোনে বলে দিলেন, ‘দায়িত্ব নিশ্চিত ভাবেই বেড়ে গেল, সন্দেহ নেই। আমি চেষ্টা করব, ভারতীয় টিমকে যাতে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।’
সেও ছিল এক জানুয়ারি মাস। অস্ট্রেলিয়ায় সফরের তৃতীয় টেস্টে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। সিডনিতে খেলতে নেমে প্রথম ইনিংসে তিন উইকেট নিয়েছিলেন। মার্ক ওয়া, মার্ক টেলর, জিওফ মার্শের উইকেট ঝুলিতে। ১৮ ওভার বল করে ৪ মেডেন সহ ৪৭ রান দিয়ে ৩ উইকেট নিয়েছিলেন। কপিল দেব, মনোজ প্রভাকরের মতো অভিজ্ঞ, উঠতি জাভাগল শ্রীনাথের মতো পেসারের ভিড়েও নিজেকে চিনিয়েছিলেন সুব্রত। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে আশ্চর্যজনক ভাবে আর বলই করানো হয়নি বাঙালি পেসারকে। সেই আক্ষেপ হয়তো আজও থেকে গিয়েছে সুব্রতর। ঘটনা হল, ওই সিডনির পর আর টেস্ট খেলতে দেখা যায়নি সুব্রতকে। তার আগে বেনসন অ্যান্ড হেজেস ওয়ার্ল্ড সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ওয়ান ডে অভিষেক হয়েছিল তাঁর। নিয়েছিলেন ৩ উইকেট। ব্রায়ান লারা, ম্যালকম মার্শাল, ডেভিড উইলিয়ামসের উইকেট ছিল ঝুলিতে। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপেও দুটো ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে ১টা টেস্ট আর ৬টা ওয়ান ডে-তেই থমকে গিয়েছিল আন্তর্জাতিক কেরিয়ার।
বাবা তারা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছিলেন পেস বোলার। বিহারের হয়েই রঞ্জি খেলেছেন তিনি। তাঁরই ছেলে সুব্রতর এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশন থেকে উঠে আসা। বিহারের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে উত্থান। আবির্ভাবেই চমকে দিয়েছিলেন। ছিপছিপে চেহারার এক ডান হাতি পেসার ৫৯টা প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ১৩৫টা উইকেট। সেরা ৭-১৮। জাতীয় টিম থেকে বাদ যাওয়ার পর বাংলার হয়ে আবার প্রত্যাবর্তনের লড়াই করেছিলেন সুব্রত। সম্বরণ তখন জাতীয় নির্বাচক। ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন। বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফিতেও পেয়েছিলেন সাফল্য। কিন্তু জাতীয় দলে আর ফেরা হয়নি। ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পরই কোচিংয়ে চলে আসেন। বিদর্ভের বোলিং কোচ হিসেবে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। এ বার সেন্ট্রাল জ়োন থেকে নির্বাচক। বোলিং কোচ সুব্রত তত্ত্বাবধানেই পেস বোলিংয়ে হাতেখড়ি সচিন তেন্ডুলকরের ছেলে অর্জুনের। ব্যক্তিগত ট্রেনার হিসেবে সচিনপুত্রকে এগিয়ে দিয়েছেন অনেকখানি।
সম্বরণ বলছিলেন, ‘দীর্ঘদিন পর বাংলার না হলেও এক বাঙালিকে পেলাম নির্বাচক হিসেবে। ওকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনি। বোলিং কোচ হিসেবেও কাজ করেছিল। এখন নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব সামলাবে। আমার তো মনে হয়, তরুণ প্রজন্মের অনেককেই খুব কাছ থেকে চেনাটা ওর কাজে লাগবে। এই মুহূর্তে ভারতীয় টিম একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আগামী প্রজন্ম উঠে আসছে। সুব্রতর মতো নির্বাচকদের কাছে কাজটা চ্যালেঞ্জিং হবে। একই সঙ্গে ওর কাছে প্রত্যাশাও অনেক।’
বাংলার না হোন, বাঙালির তো বটেই! সুব্রতর হাত ধরে কি বাংলার কোনও এক তারকার রূপকথার উত্থান হবে? মহারাজের মতো?