অমর্ত্য লাহিড়ী
কখনও কখনও বিশ্বকাপের খেলা শুধুমাত্র খেলার মাঠে আবদ্ধ থাকে না। পৌঁছে যায় রাজনীতিতে। ১৯৮৬ সালে ফকল্যান্ড যুদ্ধের প্রেক্ষিতে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মারাদোনার আর্জেন্টিনার ম্যাচ ঘিরে ছিল প্রবল উত্তেজনা। ইংল্যান্ডকে ২-০ গোলে পরাজিত করে ফকল্যান্ড যুদ্ধের প্রতিশোধ নিয়েছিলেন মারাদোনা। শুক্রবার (২ ডিসেম্বর), বিশ্বকাপের আরও এক ম্যাচে খেলা ছাপিয়ে রাজনীতি বড় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। বিশ্বকাপে অগ্রগতির প্রেক্ষিতে সার্বিয়া বনাম সুইজারল্যান্ড ম্যাচ নিশ্চিত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তবে, শুধুমাত্র খেলার মাঠেই এই ম্যাচের গুরুত্ব আটকে নেই। খেলাকে ছাপিয়ে উঁকি দিচ্ছে রাজনীতি।
বস্তুত, বিগত রাশিয়া বিশ্বকাপেই এই ম্যাচ ঘিরে তৈরি হয়েছিল তীব্র বিতর্ক। ২০১৮ সালে সার্বিয়াকে ২-১ গোলে পরাজিত করেছিল সুইজারল্যান্ড। সেই ম্যাচে গোল করেছিলেন সুইজারল্যান্ডের বর্তমান অধিনায়ক গ্রানিত জাকা এবং সুইজারল্যান্ডের সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার জার্দান শাকিরি। গোলের পর, দু’জনেই তাঁদের গোল উদযাপন করেছিলেন এক বিশেষ ভঙ্গিতে। হাতের মুদ্রায় দর্শকদের উদ্দেশে দুই মাথার ঈগল দেখিয়েছিলেন তাঁরা। যা দেখা যায় আলবানিয়ার জাতীয় পতাকায়। গোল উদযাপনের এই বিশেষ ভঙ্গিই উস্কে দিয়েছিল বড় বিতর্ক। যার জেরে তাঁদের জরিমানা করেছিল ফিফা। জরিমানা হয়েছিল সার্বিয়া ফুটবল ফেডারেশনেরও। কারণ, দর্শকাসনে সার্বিয়ার সমর্থকরা তুলে ধরেছিলেন বিদ্বেষমূলক পোস্টার-ব্যানারের মুখে ছিল বিদ্বেষমূলক স্লোগান।
আলবানিয়ার জাতীয় পতাকার প্রতীক দেখানো নিয়ে এই বিতর্ক কেন? জানতে হলে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়। ১৯৯০-এর দশকে একের পর এক গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়েছিল যুগোস্লাভিয়া। যে যুদ্ধের অবসান হয়েছিল দেশভাগের মধ্য দিয়ে। জন্ম নিয়েছিল দুটি নতুন দেশ – সার্বিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া। তবে, তখনও পরাধীন ছিল কসোভো। সার্বিয়ার অধীনে থাকা কসোভো স্বাধীন হয়েছিল ১৯৯৮-৯৯’এর কসোভো যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে স্বাধীন এই দেশটির ৯২ শতাংশ বাসিন্দাই আলবানিয়ান। সার্বিয়া বাহিনী এবং পুলিশের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়েছিল কসোভো মুক্তি বাহিনী। যুদ্ধে কসোভোর অন্তত ১২,০০০ আলবানিয়ান বাসিন্দার মৃত্যু হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ন্যাটো বাহিনীর আকাশপথে আক্রমণে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল সার্বিয়া বাহিনী। প্রায় এক দশক ন্যাটো পরিচালিত সরকারের অধীনে থাকার পর ২০০৮ সালে স্বাধীন হয়েছে কসোভো।
এখনও কসোভোর স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়নি সার্বিয়া। কসোভোর ৪ শতাংশ বাসিন্দা জাতিগত ভাবে সার্ব। চলতি বিশ্বকাপেও ব্রাজিল ম্যাচের পর, সার্বিয়া ড্রেসিংরুমে সার্বিয়ার একটি বিতর্কিত মানচিত্র দেখা গিয়েছে। সার্বিয়ার সেই বিতর্কিত মানচিত্রে, কসোভোকেও সার্বিয়ার অংশ হিসেবেই দেখানো হয়েছিল। নিচে লেখা ছিল, “আমরা হার মানব না।” সেই মানচিত্র নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রতিবাদ জানিয়েছে কসোভো। কসোভোর নিজস্ব ফুটবল দলও রয়েছে। তবে, তারা এখনও বিশ্বকাপ খেলার মতো জায়গায় পৌঁছয়নি। তাই, সার্বিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তাদের ভরসা সুইজারল্যান্ড। কারণ, সুইজারল্যান্ডই হল সেই দেশ, যাদের ফুটবল দলে কসোভো-আনবানিয়ানরা একত্রিত হতে পেরেছে।
গত বিশ্বকাপে বিতর্কের জন্ম দেওয়া জাকা এবং শাকিরি দুজনেই কসোভোতে জন্মেছিলেন। বিশ্বকাপে কসোভোবাসীর বাজি সুইজারল্যান্ডই। আর তাদের কাছে বিশ্বকাপ ফাইনাল, শুক্রবার রাতেই। দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিশাল বিশাল পর্দা টাঙিয়ে এই খেলা দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। শাকিরির জন্মস্থান জিলান ঢেকে গিয়েছে সুইস পতাকায়। তবে, ৪ বছর আগের মতো বিতর্ক এ বার হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। দর্শকাসন থেকে সার্বিয়া সমর্থকদের প্ররোচনা, উস্কানি হয়তো থাকবে। কিন্তু, ফুটবল ছাড়া আর কোনও দিকে মন দেবেন না বলে জানিয়েছেন জাকা এবং শাকিরি দু’জনেই।
সত্যিই কী তাঁদের যাবতীয় মনোযোগ থাকবে ফুটবল মাঠে? পাকিস্তানকে সামনে দেখলে যেমন তেতে যান বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মারা, সার্বিয়ানদের দেখে তেমনটা হবে না জাকা-শাকিরির মনে?