কলকাতা: ফুটবলের ময়দান হল এমন এক জায়গা যেখানে নেই ধর্ম, বর্ণের ভেদাভেদ। প্রিয় খেলা চাক্ষুস করতে সর্বস্তরের মানুষ মাঠে জড়ো হন। অফিসে সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর প্রিয় দলের খেলা যেন সব ক্লান্তি মুছে দেয়। তাইতো বিশ্বজোড়া খ্যাতি ফুটবলের। কিন্তু এই আনন্দের মধ্যেও মাঝে মাঝে ভর করে দুঃখ, নেমে আসে অভিশাপ। কখনও দুর্ঘটনা, কখনও দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে হিংসা। এমন বহু দুর্ঘটনার সাক্ষী থেকেছে ফুটবলের ময়দান। সবুজ মাঠ ভিজেছে রক্তে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ।
ফুটবল মাঠের বিপর্যয় বলতে প্রথমেই মনে পড়ে ১৬ অগাস্টের ইডেন গার্ডেন্সের অভিশপ্ত দিনের কথা। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান চিরাচরিত ফুটবল প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কেন্দ্র করে ঝামেলা। যার মর্মান্তিক পরিণতি হিসেবে ১৬ জনের অকাল মৃত্যু। ৪১ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে ওই ঘটনার। বাংলার ফুটবলের ইতিহাসে কলঙ্কময় দিন। ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে এমন বেশ কিছু ঘটনার সাক্ষী থেকেছে বিশ্ব। তার মধ্যে কয়েকটি ঘটনা এখানে তুলে ধরা হল।
এলিস পার্ক স্টেডিয়াম ট্র্যাজেডি: ২০০১ সালের ১১ এপ্রিল। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের এলিস পার্ক স্টেডিয়ামে খেলা চলছিল সাউথ আফ্রিকান লিগের। মুখোমুখি হয় কাইজার চিফস এবং অর্ল্যান্ডো পাইরেটস। ৬০ হাজার দর্শকে স্টেডিয়াম ছিল পরিপূর্ণ। তা সত্ত্বেও আরও ৩০ হাজার দর্শক স্টেডিয়ামে ঢোকার চেষ্টা করে। ভিড়ের চাপে বেশ কয়েকজন দর্শক গ্যালারি থেকে ছিটকে পড়েন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে পুলিশ। এতে হিতে বিপরীত হয়। হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় ৪৩ জনের।
দক্ষিণ আফ্রিকার ফুটবল বিপর্যয়: এলিস পার্কের মতোই দক্ষিণ আফ্রিকার ফুটবল মাঠে আরও একবার অকালে ঝরেছিল প্রাণ। এলিস পার্কের ঘটনার দশবছর আগের। ১৯৯১ সালে প্রাক মরসুম প্রীতি ম্যাচে খনির শহর ওর্কনি শহরের দুই দল কাইজার চিফস এবং অর্ল্যান্ডো পাইরেটস মুখোমুখি হয়েছিল ওপ্পেনহেইমার স্টেডিয়ামে। ম্যাচ চলাকালীন এক পাইরেটস ফ্যান কাইজার চিফ সমর্থকদের উপর ছুরি নিয়ে হামলা চালায়। দর্শকরা ভয় পেয়ে ছুটোছুটি শুরু করে। তাতেই পদদলিত হয়ে মৃত্যু হয় ৪২ জনের।
ব্রাসেলসের হেইসল স্টেডিয়াম ট্র্যাজেডি: মৃত্যু হয়েছিল ৩৯ জন মানুষের। আহতের সংখ্যা ৬০০ জনেরও বেশি। ১৯৮৫ সালে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে হেইসল স্টেডিয়ামে চলছিল ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনাল। জুভেন্টাস ও লিভারপুলের মধ্যকার সেই ম্যাচের আগে লিভারপুল সমর্থকরা জুভের ফ্যানদের আক্রমণ করে বসে। বহু পুরনো হেইসেল স্টেডিয়ামের দেওয়ালের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। জুভেন্টাসের সমর্থকদের উপর দেওয়ালটি ভেঙে পড়ে। চাপা পড়ে মৃত্যু হয় ৩৯ জন সমর্থকের। আহত শতাধিক। ঘটনার পর দীর্ঘ কয়েকবছর পর্যন্ত ইউরোপিয়ান কাপের আসর থেকে বাদ দেওয়া হয় ইংলিশ ক্লাবগুলিকে।
লুঝনিকি বিপর্যয়: ১৯৮২ সালের ২০ অক্টোবরের ঘটনা। বর্তমানে লুঝনিকি নামে পরিচিত মস্কোর স্টেডিয়ামটি লেনিন স্টেডিয়াম বলে পরিচিত ছিল। উয়েফা কাপের ম্যাচে সেদিন খেলা ছিল এফসি স্পার্টাক এবং এইচএফসি হারলেমের মধ্যে। শান্তিপূর্ণভাবেই খেলা চলছিল। স্পার্টার্ক ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় শেষ বাঁশি বাজার আগেই দর্শকরা মাঠ ছাড়েন। ইনজুরি টাইমে এফসি স্পার্টার্ক আরও একটি গোল দিয়ে বসে। জেনে বেরিয়ে যাওয়া দর্শকরা ফের স্টেডিয়ামে ঢোকার চেষ্টা করেন। রাশিয়ান নিরাপত্তারক্ষীরা বাধা দিলে বড়সড় ঝামেলার সৃষ্টি হয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌড়াতে গেলে মৃত্যু হয় ৬৬ জনের। তবে বেসরকারি হিসেব বলছে সেদিন প্রাণ গিয়েছিল ৩৪০ জন ফুটবল সমর্থকের!
কাঠমান্ডু স্টেডিয়াম বিপর্যয়: ১৯৮৮ সালের মার্চ মাস। ঘটনাস্থল কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়াম। সেদিন খেলা চলছিল নেপালের জনকপুর সিগারেট ফ্যাক্টরি এবং বাংলাদেশের লিবারেশন আর্মির মধ্যে। আবহাওয়া দারুণ ছিল। কিন্তু ম্যাচ শেষ হব হব, ঠিক তখনই যেন আবহাওয়া ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল। স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকদের মাথায় ভেঙে পড়ে শিলাবৃষ্টি। শিলের আঘাত থেকে রক্ষা পেতে দর্শকরা স্টেডিয়ামের দরজার দিকে ছোটেন। দুর্ভাগ্যবশত সেইসময় মাত্র একটি দরজা খোলা ছিল। সবাই একসঙ্গে একটি গেট দিয়ে বেরনোর চেষ্টা করলে ভিড়ে চাপে দমবন্ধ ও পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় ৯৩ জনের। আহতের সংখ্যা ছিল ১০০-র বেশি।