ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস সেই কবে থেকে ময়দানের জার্সি পরে বসে রয়েছে। নতুন শতাব্দীতে পা দিয়েও ময়দান ঘিরেই পায়ে পায়ে এগিয়ে রয়েছে ইতিহাস। কত গল্প উপহার দিয়েছে এই ময়দান। আরও ভালো করে বলতে গেলে, কলকাতা ডার্বি (Kolkata Derby) ঘিরে কত উত্তেজনা, কত উত্তাপ। তিন বছর পর আবার ডার্বি ফিরছে কলকাতায়। সেই চিরকালীন ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ডার্বির নানা গল্প নিয়েই TV9Bangla -র এই ধারাবাহিক— ডার্বির হারিয়ে যাওয়া গল্প। আজ অতীতে ফিরলেন আইএম বিজয়ন (I.M. Vijayan)।
আমি তখন কেরল পুলিশে খেলি। মোহনবাগানের বিরুদ্ধে একটা ম্যাচে ভালো খেলায় নজরে পড়ে গেলাম। সালটা ১৯৯১। মোহনবাগানের মতো ক্লাবে খেলার সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়! কলকাতায় আসার পরই বড় ম্যাচের উত্তাপ টের পেয়েছি। কেরলেও ফুটবলের উন্মাদনা কম নয়। কিন্তু তার সামনে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান বড় ম্যাচের উন্মাদনা, তুলনাতেও আসবে না। ডার্বির আগে রোজ প্র্যাক্টিস দেখতে আসত সমর্থকরা। মাঠ ছেড়ে বেরনোর সময় কত আব্দার। আমাদের সময় সেলফি ছিল না। সমর্থকরা খাতা বাড়িয়ে দিত অটোগ্রাফের জন্য। বড় ম্যাচের দিন যত এগিয়ে আসত, সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা তত বাড়ত। সেই দৃশ্য এখনও রয়ে গিয়েছে কলকাতা ফুটবলে। শুধু মুখগুলো পাল্টে গিয়েছে। বিজয়ন, বাইচুং, ব্যারেটো, রেনেডি, আনচেরির বদলে আজকের ছেলেরা। কোভিডের জন্য ২ বছর কলকাতায় ডার্বি হয়নি। সমর্থকরাও বড় ম্যাচের উত্তাপ নিতে পারেনি। ডুরান্ডের ডার্বি ঘিরে উত্তেজনা যে তুঙ্গে উঠবেই, কেরলে বসেই টের পাচ্ছি।
১৯৯১ সালে মোহনবাগানে সই করার পর প্রথম বড় ম্যাচে গোল পাইনি। ওই ম্যাচে চিমা গোল করেছিল। কলকাতায় এসে দেখেছি, অন্য ম্যাচে যাই হোক না কেন, ডার্বি জিততেই হবে। ক্লাবের কর্তা থেকে সমর্থক- প্রত্যেকের মুখে ওই একটাই কথা। বড় ম্যাচের গুরুত্ব কী, তখন বুঝতাম না। কলকাতায় এসে প্রথমে অঞ্জন মিত্রের বাড়িতে ছিলাম। তারপর কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাট খুঁজে দিল কর্তারা। ৫ নং ট্যাঙ্কের কাছে ওই ফ্ল্যাটে আমি আর সত্যেন থাকতাম। আনচেরি তখনও মোহনবাগানে আসেনি। ও আসার পর নিউ আলিপুরে চলে গিয়েছিলাম।
জীবনে অনেক বড় ম্যাচই খেলেছি। বেশির ভাগই খেলেছি সবুজ-মেরুন জার্সিতে। দুই দফায় মোট ৫ বছর মোহনবাগানে খেলি। ৯১ সালে যখন এসেছিলাম, জাতীয় লিগ চালু হয়নি। কলকাতা লিগ, ডুরান্ড কাপ, ফেডারেশন কাপ, আইএফএ শিল্ড, এয়ারলাইন্স গোল্ড কাপ এগুলোতেই টক্কর হত। যুবভারতীতে প্রথম বড় ম্যাচ খেলতে নামার সময় ভয় হচ্ছিল। অত মানুষের সামনে নিজেকে মেলে ধরতে হবে। পারব তো? কেরলে দর্শকদের সামনে খেলার অভিজ্ঞতা থাকলেও, বড় ম্যাচ আলাদা। ইস্টবেঙ্গলও তখন শক্তিশালী দল ছিল।
আমার জীবনের সেরা বড় ম্যাচ ১৯৯৩-র ডার্বি। ওই ম্যাচটা ভুলতে পারব না। নইম স্যার ( সৈয়দ নইমুদ্দিন) তখন কোচ। কড়া অনুশীলন চলছে। বড় ম্যাচের আগের দিন আমাকে টুটু বসু ডাকলেন। নইম স্যারও ছিলেন ঘরে। টুটুদা আমাকে বললেন, “ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে তোমাকে ৩ গোল করতে হবে। তাহলে একটা মোটরবাইক উপহার দেব।” কথাটা শোনার পর ভালো খেলার তাগিদ আরও কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল।
সেই বড় ম্যাচে তিন গোল করতে পারিনি, তবে দু’গোল করেছিলাম। আমার জোড়া গোলেই দল ম্যাচ জিতেছিল। ফ্রি কিক থেকে করেছিলাম একটা গোল। ম্যাচের পর আমি সোজা টুটুদার কাছে যাই। গিয়ে বায়না করে বলি, ৩টে গোল করতে পারিনি, কিন্তু ২টো গোল তো করেছি! মোটরবাইক দিতেই হবে কিন্তু। টুটুদা মোটরবাইক না দিলেও, আমাকে একটা নতুন স্কুটার উপহার দিয়েছিলেন। ওটাই জীবনের অন্যতম সেরা প্রাপ্তি। একটা বড় ম্যাচ মানুষের জীবনকে বদলে দেয়। তারপর থেকে ওই স্কুটার নিয়েই প্র্যাকটিসে যেতাম।
মোহনবাগানে ৫ বছর খেলার পর ইস্টবেঙ্গলেও দু’দফায় ২ বছর খেলেছি। লাল-হলুদ জার্সিতে বড় ম্যাচে সে ভাবে সাফল্য না থাকলেও, ইস্টবেঙ্গল আমার মন জিতে নিয়েছিল। এখনও ইস্টবেঙ্গলের অনুষ্ঠানে কর্তারা আমন্ত্রণ জানায়। ইস্টবেঙ্গলে আরও কয়েকটা বছর বেশি খেলতে পারলে ভালো লাগত। হয়তো ডার্বির লাল-হলুদ উত্তাপ আরও বেশি পেতাম।
(কৌস্তভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুলিখন)