দীপঙ্কর ঘোষাল
আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। যাঁরা মানসিক স্বাস্থ্য শুনলেই পাগল, উন্মাদ, মানসিক ভারসাম্যহীন মনে করেন, এর অর্থ তা নয়। বরং বলা যেতে পারে, এক-এক জনের ‘দৃষ্টিকোণ’ এক-এক রকম। অথবা বলা যেতে পারে, সাফল্য আর ব্যর্থতার পুরোটাই নির্ভর করে মানসিক স্বাস্থ্য কিংবা মানসিক কাঠিন্যের উপর।
সার্ভিসেসকে হারিয়ে জাতীয় গেমসের ফাইনালে উঠেছে বাংলা ফুটবল দল। এতক্ষণে এটুকু অন্তত বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা জেনে গিয়েছেন। কিন্তু নেপথ্য লড়াই? অনেকটাই জানা নেই। এই লড়াইয়ের গভীরে ঢুকতে হলে আমাদের হাঁটতে হবে পিছনে। কলকাতা প্রিমিয়ার ‘এ’ ডিভিশনের খেলা চলছে। এমন সময় জানা গেল, এ বার গুজরাত হবে জাতীয় গেমস। চিন্তায় পড়ল আইএফএ। কলকাতা লিগ দ্রুত শেষ করতে না পারলে সেরা ফুটবলার পাওয়া যাবে কোথা থেকে! লিগ দ্রুত শেষ করে, ট্রায়াল এবং দল বেছে নেওয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। সেই সুযোগই এল না। সেরা দলগুলি সুপার সিক্সে যোগ্যতা অর্জন করেছে। তাদের ফুটবলার পাওয়া কঠিন। কোচই বা কে হবেন? এত্ত কম সময়ের মধ্যে দল বেছে নেওয়া, প্রস্তুতি এবং জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় খেলতে যাওয়া সহজ কথা নয়। কলকাতা লিগ শেষ হওয়ায় অপেক্ষায় থাকলে, ততদিনে জাতীয় গেমসও শেষ হয়ে যাবে। দীর্ঘ ৭ বছর পর হচ্ছে জাতীয় গেমস। এত বড় একটা টুর্নামেন্টে দল পাঠাতে না পারলে আফসোস থেকে যাবে। বাংলা ফুটবল সংস্থার তরফে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যে দলগুলি সুপার সিক্সে ওঠেনি, তাদের ফুটবলারদের নিয়েই বাংলা দল গড়া হবে।
কোচ হিসেবে দায়িত্ব নিতে আইএফএ অনুরোধ করল বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যকে। ময়দান চেনেন। নিজে এই ময়দানে ফুটবল খেলেছেন, বিভিন্ন দলের কোচিং করিয়েছেন। এটুকু সময়ের মধ্যে জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতা জেতার মতো দল গড়ার চ্যালেঞ্জ নেওয়া সহজ নয়। বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য সেটা নিয়েছিলেন। প্রিমিয়ার ডিভিশনের ৩০ জন ফুটবলারকে ট্রায়ালে ডাকা হয়। অনেক নতুন, অচেনা মুখ। কল্যাণীতে মাত্র ৭ দিনের ট্রায়াল। একই সঙ্গে তাদের প্রশিক্ষণও দেন বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য। ৩০ জন থেকে ২০ জনের মূল দল বেছে নেওয়া হয় জাতীয় গেমসের জন্য। কোচ ভরসা করেই নিয়েছেন। জাতীয় স্তরের একটি প্রতিযোগিতার প্রস্তুতির জন্য মাত্র ৭ দিন!
লড়াইয়ের এখানেই শেষ নয়। বরং শুরু। গুজরাটে জাতীয় গেমসের ব্যবস্থাপনার দিক থেকে কোনও ত্রুটি নেই। থাকার সু-ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যকর খাবার, চিকিৎসার সু-বন্দোবস্ত। কিন্তু সময়ের বড় অভাব। প্রত্যেকটা দলের জন্যই প্রস্তুতির নির্দিষ্ট সময় বেছে দেওয়া হয়েছিল। প্রথম দিন প্রস্তুতিই সারতে পারেনি বাংলা দল। দু’ম্যাচের মাঝে মাত্র এক দিনের বিরতি। ফুটবলারদের রিকভারির পর্যাপ্ত সময় নেই। কোচের কথা ফেলেননি ফুটবলাররা। প্রস্তুতি এবং ম্যাচে নিজেদের সর্বস্ব দিয়েছেন। ক্লান্তির কথা মাথায় আসতে দেননি। লক্ষ্য সোনার পদক। গ্রুপ পর্বে তিনটি ম্যাচই জিতে সেমিফাইনাল। সার্ভিসেসকে ১-০ হারিয়ে ফাইনালে। সোনার পদকের ম্যাচে বাংলার প্রতিপক্ষ কেরল। সেমিফাইনাল এবং ফাইনালের মাঝেও মাত্র একটা দিন। রবিবার সন্ধ্যায় ম্যাচ খেলেই সোমবার বিকেলে ফের অনুশীলন। মঙ্গলবার সোনার পদকের ম্যাচ।
ফুটবলাররা যেমন কোচকে সম্মান দেন, কোচও প্লেয়ারদের ভরসা করেছেন। তারই ফসল এই ফাইনালে পৌঁছান। দলের বেশিরভাগ ফুটবলারই আদিবাসী। ফুটবল খেলা এক দিকে তাঁদের কাছে যেমন প্যাশন, তেমনই বেঁচে থাকার লড়াইও। ময়দানে খেলে যেটুকু রোজগার হয়, সংসারের কাজে লাগে। দু-তিন জন ফুটবলারের কথা আলাদা করে বলতেই হয়। আর্থিক বাধাই শুধু নয়, তাদের মানসিক শক্তির পরিচয়ও পাওয়া যায়। প্রথম জন সুরজিৎ হাঁসদা। দু’বছর আগে খেপের মাঠেই খেলতেন সুরজিৎ। প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব ক্যালকাটা কাস্টমসের কর্তা তাঁর খেলা দেখেন। পছন্দ হয়। সুরজিতের সঙ্গে যোগাযোগ করে দলে নেন। সুরজিতের বাড়ি মেমারিতে। সেখান থেকে কলকাতা পাড়ি দেওয়া। এ বছরও কাস্টমসে খেলেন সুরজিৎ। দল সুপার সিক্সে যেতে পারেনি। সুরজিতের কাছে সুযোগ এল জাতীয় গেমসের জন্য বাংলা দলের ট্রায়ালের। কোচ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যরও তাঁর খেলা পছন্দ হয়। জাতীয় গেমসে যেমন গোলের অ্যাসিস্ট করেছেন তেমনই গোলও করেছেন। সেমিফাইনালে তাঁর একমাত্র গোলেই জেতে বাংলা। ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে গুরুতর চোট পান সুরজিৎ। এক্সরে-স্ক্যান করানো হয়েছে। রিপোর্ট স্বস্তিরই। খুব সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা সুরজিৎ বাংলার সাফল্যের অন্যতম কারিগর। দলের আর এক ফুটবলার দীপেশ মুর্মু। তাঁর বাড়ি মগরায়। খুবই সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা। বাবা চাষের কাজ করেন। ইউনাইটেড স্পোর্টসের ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট থেকে উঠে আসা। কলকাতা লিগে ইউনাইটেড স্পোর্টসেই খেলেন দীপেশ। জাতীয় গেমসের ট্রায়ালে নজর কেড়ে বাংলা দলে।
ফুটবলে শুধু গোল করে ম্যাচ জেতা যায় না। দলের আক্রমণভাগ, মাঝমাঠ যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ঠিক একইরকম রক্ষণভাগও। বাংলা রক্ষণভাগে প্রতি ম্যাচেই ভরসা দিয়েছেন আকাশ মুখোপাধ্যায়। গত বছর কলকাতা লিগে পিয়ারলেসের হয়ে খেলেন আকাশ। খুবই ভালো পারফরম্যান্স। ফুটবল মাঠের অনেক আক্রমণ সামলে দিলেও জীবনের লড়াইয়ে পেরে ওঠেননি। আবার হারেনওনি আকাশ। গত বছরের ঘটনা। ম্যাচ খেলতে আসার পর জানতে পারেন, বাবার মৃত্যু হয়েছে। বাবা বেঁচে থাকলে যেটা হয়তো ছেলের থেকে প্রত্যাশা করতেন,আকাশ সেটাই করেছেন। আকাশ ম্যাচ ছেড়ে যাননি। ম্যাচে একশো শতাংশ দিয়েছেন। রক্ষণ সামলাতে গিয়ে মাথা ফেঁটেছে। ম্যাচের সেরার পুরস্কার জিতেছেন আকাশ। বাবার মৃত্যুর যন্ত্রণা চেপে কতটা ভালো পারফরম্যান্স, আন্দাজ করা যায়। ম্যাচ শেষে বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে যান আকাশ। সংসারের দায়িত্বও এসে পড়ে আকাশের কাঁধে।
গত মরসুমে বাংলার সন্তোষ ট্রফির ট্রায়ালে সুযোগ পান আকাশ। ৩০ জনের মধ্যে থেকে প্রথম ২০-তে ঢুকতে পারেননি। তাঁর চেয়েও যোগ্যরা সুযোগ পেয়েছিলেন। বাংলা দলে সুযোগ না পাওয়ার আক্ষেপ থাকলেও ভেঙে পড়েননি আকাশ। এ বারের লিগে নজর কেড়ে জাতীয় গেমসের ট্রায়ালে সুযোগ এবং বাংলা দলে জায়গা করে নিয়েছেন আকাশ। জাতীয় গেমসে প্রতিটা ম্যাচেই বাংলার রক্ষণে ভরসা দিয়েছেন। তাঁর প্রত্যাবর্তন, মানসিক শক্তি কুর্নিশ জানানোর মতোই।
অমসৃণ পথ পেরিয়ে ফাইনাল অবধি পৌঁছানো, একমাত্র ওঁরাই উপলব্ধি করতে পারবে। এতটা পথ পেরিয়ে, এ বার লক্ষ্য সোনার পদক। অন্য কোনও রঙের পদক নিয়ে ফেরার ইচ্ছে বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের দলের নেই!