তিথিমালা মাজী
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির ঠিক তিনদিন আগে স্পেনের তরিফা শহরে অভিনব কাণ্ড ঘটিয়ে বসলেন এক বাঙালি মেয়ে। সাহস যে কম নয়, উলুবেড়িয়ার ২৮ বছরের তাহরিনা নাসরিন (Tahrina Nasrin) তা প্রমাণ করে দিলেন। সাফল্য পেলে ভালো লাগে। কিন্তু সেই সাফল্য যদি একের পর এক ঘূর্ণিঝড় পার করে আসে, তার স্বাদই হয় অন্যরকম। তাহরিনার স্পেনের তরিফা শহরে বসে তারিয়ে তারিয়ে নিজের সাফল্য যখন উপভোগ করছেন, তখন গলায় যন্ত্রণাও কম নেই। কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে টিভি নাইন বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কোনও কিছুই গোপন করলেন না। জিব্রাল্টার চ্যানেল (Gibraltar Channel) পার করতে গিয়ে শুধু কাঠখড় নয়, তাঁর স্বপ্নেরও অনেকখানি যে পুড়েছে, মিলল তারই আভাস। কী সেই যন্ত্রণা? চলুন শুনে নিই তাহরিনা নাসরিনের মুখে…
উলুবেড়িয়া থেকে সুদূর স্পেনে গিয়ে জিব্রাল্টার চ্যানেল জয় করা সহজ ছিল না। ২০১৮ সাল থেকে বারবার চেষ্টা করেও স্পেনের ভিসা জোগাড় করতে পারেননি। তার কারণই হল অর্থের টানাটানি। কোনও রাখঢাক না করেই তাহরিনা বলে ফেললেন, “জিব্রাল্টার চ্যানেলে নামার জন্য ৭ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। এই টাকা কোথা থেকে আসবে, কে দেবে কিছুই জানতাম না। প্রথমে ভেবেছিলাম, স্পনসর পেয়ে যাব হয়তো। কিন্তু শত চেষ্টা করেও কাউকে পাশে পাইনি। এমনকী রাজ্য সরকারের তরফেও কোনওরকম সহযোগিতা করা হয়নি। একটা সময়ে ভেঙে পড়েছিলাম। মনে হয়েছিল জিব্রাল্টার চ্যানেল পার করার স্বপ্ন বন্ধ করে দিতে হবে। কিন্তু আমার স্বপ্ন, ইচ্ছে, তাগিদ বোধহয় এর কাছে কিছুই নয়। নাহলে এত প্রতিকূলতার মধ্যে স্পেনে পা রাখতে পারতাম না।”
কষ্ট করে অর্থ জোগাড় করেছিলেন ঠিকই, তারপরও যে স্বপ্নপূরণ হত, তা বলা যাচ্ছে না। স্পেনের পথে পাড়ি দেওয়ার সময়ই জ্বর ছিল তাহরিনার। এমনকী জিব্রাল্টার চ্যানেল যেদিন পার করেন, বৃহস্পতিবারও বেশ জ্বর ছিল উলুবেড়িয়ার মেয়ের। কিন্তু নিজের স্বপ্নের সামনে শারীরিক কোনও সমস্যাকে বড় বলে মনে হয়নি তাহরিনার। এতটাই মরিয়া ছিলেন যে তাঁর জ্বরে পড়ার কথাও গোপন করে গিয়েছিলেন। স্পেন থেকে হাসতে হাসতে তাহরিনা বলছিলেন, “একটা সময় তো ভয়ই হচ্ছিল আমার। গায়ে বেশ জ্বর। এদিকে জিব্রাল্টার চ্যানেলে আমাকে নামতেই হবে। যদি আমার জ্বর হওয়ার কথা আয়োজকদের বলি তাহলে হয়তো নামতেই দেবে না আমাকে। এতদূর এসে তেমন কিছু ঘটুক, আমি একেবারেই চাইনি। তাই জ্বর হওয়ার কথা বেমালুম চেপে গিয়েছিলাম।”
কেউ যখন স্বপ্ন ছুঁতে মরিয়া হয়ে ওঠেন, বাধার ছোট ছোট পাহাড়গুলোও অবলীলায় টপকে যান। ১২ বছরের কেরিয়ারের মধ্য দিয়ে তাহরিনা বুঝেছেন কঠিন থেকে কঠিনতর পরিস্থিতি পার করলে তবেই সাফল্য পাওয়া যায়। আজ স্পেনে যখন তেরঙা উড়িয়ে দিয়েছিলেন তখন দু চোখ জলে ভরে যাচ্ছিল বাংলার মেয়ের। উলুবেড়িয়ার এই তাহরিনাকে ‘জলপরী’ বলেই ডাকা উচিত। অসম্ভবকে সম্ভব করা বাংলার সাঁতারু ‘গুরু’ মাসুদুর রহমানের হাত ধরে তাঁর উঠে আসা। ইংলিশ চ্যানেল পার করেছিলেন মাসুদুরের প্রেরণায়। ২০১৫ সালে মারা গিয়েছেন মাসুদুর। এই গুরুই বোধহয় তাঁকে শিখিয়ে গিয়েছেন, প্রতিবন্ধকতা কীভাবে ভেঙে ফেলতে হয়। মনের জোর দিয়েই পার করে ফেলা যায় অসম্ভব যেকোনও চ্যানেল।
প্রয়াত গুরুকে সাফল্য উৎসর্গ করে তাহরিনা বললেন, “জিব্রাল্টার চ্যানেল জয়ের করার পর মাসুদুর স্যারের কথা খুব মনে পড়ছিল। ইংলিশ চ্যানেল পার করার আগেই তিনি বলেছিলেন, ইংলিশ চ্যানেল জয় করবি তারপর জিব্রাল্টার। তারপর…? জিজ্ঞাসা করেছিলাম স্যারকে। তিনি এক আশ্চর্য স্বপ্নের কথা শুনিয়েছিলেন। বলেছিলেন, তুই আর আমি দু’জন মিলে ক্যাটালিনা চ্যানেল জয় করব। স্যার আজ আর নেই। কিন্তু ওঁর দেখানো স্বপ্ন আমাকে ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে। ইংলিশ, জিব্রাল্টার হয়ে গেল, স্যারের স্বপ্ন এক এক করে পূরণ করতে চাই। তার আগে আমার টার্গেট নর্থ চ্যানেল পার করা।
বাংলার সাঁতারুর সাফল্যের দিনও একগলা অভিমান জলে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কিছু না পাওয়ার হতাশা ভুলে আবার স্বপ্নের পিছনে ছুটতে শুরু করেছেন তাহরিনা। তার মধ্যেও আবার স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছেন বাংলার সাঁতারু।