না-বুঝেই রোজ অপরাধের শিকার মানুষ, সাইবার ক্রাইম সচেতনতায় বিশেষজ্ঞের টিপস
Cyber Crime All Over India: বিশ্বে প্রতিদিন কতবার আমার-আপনার মতো অগুণতি মানুষের অজান্তে বিভিন্ন ডিভাইসে সাইবার হামলা (Cyber Attack) হয়, জানেন? ‘সিকিউরিটি ম্যাগাজিন’ (Security Magazine)-এর (2023-এর 8 ডিসেম্বর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী) তথ্য বলছে, প্রতিদিন 2,200টিরও বেশি সাইবার জালিয়াতির ঘটনা ঘটে পৃথিবীতে। TV9 Bangla-র তরফে যোগাযোগ করা হয় সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ তথা আইনজীবী রাজর্ষি রায় চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি কী বলছেন?
অন্বেষা বিশ্বাস—
একসময় ‘ফোর টোয়েন্টি’ (420) বা ‘চারশো বিশ’ (420; হিন্দি উচ্চারণে ‘চারসো বিস’) বললে বোঝানো হত জালিয়াত বা প্রতারককে। প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের সাহায্যে বেঁধে ফেলা হয়েছে যে পৃথিবী, সেই 24X7 ‘কানেক্টেড’ পৃথিবীতে (connected world) জালিয়াতির সংজ্ঞা বদলে গিয়েছে—এবং বদলে যাচ্ছেও প্রতিনিয়ত। এর অন্যতম প্রধান কারণ হল সাইবার জালিয়াতি (Cyber Crime)। মোবাইল, ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, প্যাড—দৈনন্দিনের জীবনে এসবের সৌজন্যে যেভাবে অগুণতি অ্যাপ (app) প্রতি মুহূর্তে আমার-আপনার বিভিন্ন তথ্য জেনে নিচ্ছে, তাতে অহরহ বাড়ছে এই সাইবার জালিয়াতি। এ প্রসঙ্গে আরও একটা তথ্য শেয়ার করে রাখা উচিত। বিশ্বে প্রতিদিন কতবার আমার-আপনার মতো অগুণতি মানুষের অজান্তে বিভিন্ন ডিভাইসে সাইবার হামলা (Cyber Attack) হয়, জানেন? ‘সিকিউরিটি ম্যাগাজিন’ (Security Magazine)-এর (2023-এর 8 ডিসেম্বর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী) তথ্য বলছে, প্রতিদিন 2,200টিরও বেশি সাইবার জালিয়াতির ঘটনা ঘটে বিশ্বে। আরও সূক্ষ্মভাবে হিসেব করলে দাঁড়ায়, প্রতি 39 সেকেন্ডে আনুমানিক 1টি করে। আগাগোড়াই কি এমনটা ছিল? বিশেষজ্ঞদের মতে, 2019 থেকে 2020 সাল পর্যন্ত কোভিড-19-এর সময় সাইবার ক্রাইমের শিকার (Cyber Crime Victim)-এর সংখ্যা বেড়েছে। কোভিড-19 মহামারী চলাকালীন 2020 সালে বিশ্বে সাইবার ক্রাইমের সংখ্যা বেড়েছে 69%।
চোখ কপালে তুলবে ভারতের প্রতারণার ঘটনার পরিসংখ্যান…
গোটা বিশ্বের মধ্যে ভারতে সাইবার জালিয়াতির ঘটনার পরিসংখ্যান দেখলে আপনার চোখ কপালে উঠবে। কারণ সেই রিপোর্ট আরও ভয়াবহ। গোটা বিশ্বের গড়ের সঙ্গে তুলনায় দেখা যাচ্ছে, পৃথিবী জুড়ে যত সাইবার প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় দ্বিগুণ ঘটনা ঘটেছে ভারতে। ভারতীয় সাইবার স্পেস গত ছয় মাসে গড়ে 2,127 বার সাইবার জালিয়াতির সাক্ষী হয়েছে, যা বৈশ্বিক গড় (worldwide average of cyber crime) 1,108-এর চেয়ে অনেক বেশি। এই চাঞ্চল্যকর তথ্য শুনে মাথায় হাত বিশেষজ্ঞদের। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের সাইবার বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে পুলিশ-প্রশাসনের বড়কর্তাদের দুশ্চিন্তাও বেড়ে গিয়েছে। ফলে সাইবার প্রতারণা থেকে বাঁচতে হলে মানুষের আরও বেশি করে সচেতন হওয়া জরুরি বলে মনে করেছেন সাইবার বিশেষজ্ঞরা। TV9 Bangla-র তরফে যোগাযোগ করা হয় সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ তথা আইনজীবী রাজর্ষি রায় চৌধুরীর সঙ্গে। তাঁর উদ্দেশে প্রথম প্রশ্ন:
প্রশ্ন: সারা বিশ্ব জুড়ে যত সাইবার অপরাধের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় দ্বিগুণ ঘটনা ঘটেছে ভারতে। এর পিছনে কারণ কী-কী?
উত্তর: যদি ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনও একটা সংস্থার কাছে ভারতবর্ষ সবচেয়ে বড় বাজার হয়, তাহলে সাইবার ক্রাইমের ক্ষেত্রেও তো এই দেশই সবথেকে বড় বাজার। কারণ এ দেশের জনসংখ্যা। আর শিক্ষার অভাব এতটাই যে, একজন মানুষকে বোকা বানানো খুব সহজ। সেই কারণে সাইবার ক্রাইমের বাড়বাড়ন্ত এদেশের মাটিতে অনেকটাই বেশি। মানুষের হাতে-হাতে স্মার্টফোন। কিন্তু ব্যবহারের সঠিক উপায় তাদের জানা নেই। শুধু তাই-ই নয়, শেখানোর জন্য কোনও প্রকল্পও নেই। ফলে খুব সহজেই সাইবার ক্রাইমের মতো অপরাধের ফাঁদে পড়ে সাধারণ মানুষ।
প্রশ্ন: এ ধরনের অপরাধের ভবিষ্যৎ কী?
উত্তর: সাইবার জালিয়াতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিরোধী প্রযুক্তিশিল্পও বড় হচ্ছে। সাইবার অপরাধকে এখন অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু তাতেও কেন বাড়ছে এই অপরাধ? নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের নিরাপত্তাপ্রযুক্তি নিয়ে গুণগান গাইতে নিশ্চয়ই শুনেছেন। তবে তাদের সমস্যা হল, হ্যাকিং রিপোর্ট বা প্রতারণার বিষয়টি সামনে আনে না সে সব সংস্থা। ফলে হ্যাকাররা তথ্য হাতিয়ে নিলে তারা নিজেরাও ক্ষতির মুখে পড়ে। আর আপনার-আমার মতো সাধারণ মানুষ? তাদের আর উপায় কী? সাধারণ মানুষ সাইবার হামলার শিকার হলে খুব কম ক্ষেত্রেই পুলিশের কাছে যান। কেন বলুন তো? হয়তো ঝামেলা পোহানোর ভয়ে! ফলে এ ধরনের ক্ষতি পরোক্ষভাবে নিজেই বহন করে নেন অনেকেই। ব্যাঙ্ক ও বিমা আবার অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষতিপূরণ দেয়। তাই সাইবার অপরাধীরা এ ক্ষেত্রে দিন-দিন আরও প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। এতেই বাড়ছে জালিয়াতির সংখ্যা।
প্রশ্ন: পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগে অভিযোগ জানানোর ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অনীহা কেন দেখা যায়?
উত্তর: সাইবার ক্রাইমে অভিযোগ জানানোর ক্ষেত্রে মানুষের অনীহার মূল কারণ হল, ফলপ্রসূ সুরাহার অভাব। আর দ্বিতীয় কারণ হল, অসংখ্য সাইবার ক্রাইম আমাদের চারপাশে ঘটলেও অত্যন্ত কম সংখ্যক মানুষ এই সাইবার ক্রাইম নিয়ে তদন্তভার সামলাচ্ছেন। ফলে তাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হয়ে উঠছে না সমস্ত অভিযোগের তদন্ত যথাযথভাবে করা। ফলে অভিযোগকারী ব্যক্তিদের সমস্যারও সমাধান হচ্ছে না। তারপরে ধরুন, কোনও একজন সাধারণ মানুষ সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়ে স্থানীয় থানায় যাচ্ছেন। অথচ বাস্তবে সেই থানার পুলিশকর্মীরা এই সব বিষয়ে ততটা অবগতই নন। ফলে সেক্ষেত্রে পুলিশের জবাব থাকে, ‘আপনি অভিযোগ করুন। আপনার অভিযোগ সাইবার পুলিশ স্টেশনে পাঠানো হবে।’ এবার সাইবার পুলিশ স্টেশন সেই অভিযোগ নেওয়ার পর 6 মাস, 7 মাস কেটে যাচ্ছে, কিন্তু কোনও লাভের লাভ হচ্ছে সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েছেন যিনি, সেই ব্যক্তির। ফলে সাধারণ মানুষ থানা-পুলিশের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে পিছপা হচ্ছেন।
প্রযুক্তির হাত ধরে অপরাধের বিস্তার এখন গ্রামেগঞ্জে। প্রতিটি থানায় অভিযোগের ফাইল জমা পড়ে থাকে গাদা-গাদা। তারপর প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমেই ধরা হয় সেই সব অপরাধীদের। তারপরও সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে মানুষ পুলিশের কাছে যেতে ভয় পায় কেন? পুলিশের কাছে গিয়েও ভুক্তভোগীরা কেন প্রতিকার পাচ্ছেন না বা সন্তুষ্ট হচ্ছেন না? তার কারণগুলো কি আদৌ খতিয়ে দেখা হচ্ছে? নাকি এই কারণ খুঁজে বের করা হচ্ছে না বলেই বাড়ছে জালিয়াতি?
প্রশ্ন: সাইবার ক্রাইমের তদন্তের জন্য পুলিশকেও তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নিতে হচ্ছে। পুলিশ নিজেকে কতটা আপডেট করছে?
উত্তর: কোনও সাইবার ক্রাইমের তদন্তের জন্য যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়, তা হল: ডিজিটাল প্রমাণ (Digital Evidence)। আর যে সোশ্যাল মিডিয়া (social media platform)-এর মাধ্যমে জালিয়াতি হয়েছে, সেই প্ল্যাটফর্ম থেকেই ডিজিটাল প্রমাণ সংগ্রহ করতে হয়। সাইবার অপরাধের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিরই যে সাহায্য নেওয়া হবে, সেটাই স্বাভাবিক।
প্রশ্ন: সাইবার অ্যাটাকের ক্ষেত্রে ভারত হ্যাকারদের অন্যতম টার্গেট। আগামিদিন কতটা আশঙ্কার?
উত্তর: হ্যাকারদের কাছে ভারত অন্যতম টার্গেট হওয়ার প্রধান কারণ হল, ব্যবহারকারীদের সচেতনতা এদেশে নেই বললেই চলে। দেশের মানুষ পুলিশ-প্রশাসনের উপর নির্ভর করতে চাইলেও সে সব পরিকাঠামো দুর্বল।
প্রশ্ন: অনলাইন কেনাবেচার ক্ষেত্রে ইউজ়ারদের কী-কী করণীয়?
উত্তর: অনলাইন কেনাবেচার ক্ষেত্রে সাইবার ক্রাইমের ঘটনা বেশি ঘটে। এর সবথেকে বড় কারণ হল, মানুষ কম দামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কিছু ভুল পদক্ষেপ করে ফেলেন। আর তার ফলেই বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে দেখানো সস্তার অফারের লোভে পরে অর্ডার করেন। তাতেই হয় বিপদ।
TV9 বাংলায় ইতিমধ্যেই যে সব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেই অনুযায়ী-
1. হোয়াটসঅ্যাপ, ইমেল, এমনকি টেক্সট মেসেজেও প্রতারকরা Flipkart এবং Amazon সেলের নাম করে আপনার সামনে এমনই কিছু লোভনীয় অফার নিয়ে আসবে, তা দিয়ে ভুয়ো, ম্যালিশিয়াস ওয়েবসাইটে আপনাকে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানেই যখনই আপনি ব্যক্তিগত তথ্যগুলি দেবেন, সেখান থেকেই আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢুকে পড়ার রাস্তা তৈরি করে ফেলবে প্রতারকরা।
2. পেমেন্ট করতে আপনি যদি ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন, তাহলেও আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। যে কোনও ব্যাঙ্কের ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড হোক না কেন, অনলাইনে পেমেন্ট করার সময় কার্ডের কোনও তথ্য সেভ করতে যাবেন না।
3. অনলাইনে কেনাকাটি করার সময় অবশ্যই অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে গিয়ে অর্ডার করবেন। ফ্লিপকার্ট ও অ্যামাজনের মতো ই-কমার্স সাইগুলি আদৌ সেল শুরু করেছে কি না, তা জেনে নিন।
প্রশ্ন: এক্ষেত্রে ভারতের হাল কী?
উত্তর: গত কয়েক বছরে ভারতে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়েছে অনেক গুণ। সেই সঙ্গে এদেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে সাইবার অ্যাটাক হয়েছে, একথাও জেনেছে গোটা বিশ্ব। ভবিষ্যতে যে এই ধরনের নিরাপত্তার ঘাটতি আরও বাড়বে, তা নিয়ে তীব্র আশঙ্কাও রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। আর এটাই আসল সময়, যখন গোটা দেশকে সাবধান হতে হবে। নিয়মিত তথ্য বা ইনফরমেশন সিকিউরিটি পর্যালোচনা করা, ব্যক্তিগত ই-মেইলের সঙ্গে অফিসের ই-মেইল গুলিয়ে না-ফেলা, অফিসের যে কোনও তথ্য আদান-প্রদান করার জন্য ব্যক্তিগত ই-মেইল ব্যবহার না করা এবং আরও অনেক কিছু। কিন্তু প্রথমেই কেন এসবের দিকে নজর রাখতে হবে? কারণ হল হ্যাকাররা যে কাজটা এখন শুধু আপনার-আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে, সেটা আর থাকবে না। এখনও পর্যন্ত কারও অ্যাকাউন্ট থেকে চলে যাচ্ছে লাখ টাকা, কারও অ্যাকাউন্ট থেকে কোটি-কোটি! আজ সাইবার জালিয়াতির শিকার জনসাধারণ। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, শীঘ্রই সাইবার আক্রমণের মুখে পড়বে বিশ্বের নামজাদা সংস্থাগুলোও! তাই হয়তো ভাবতে হবে কিছুটা এগিয়েই। তাহলে যদি রেহাই পেতে পারে এ দেশ।