কমলেশ চৌধুরী
বিপর্যয় এলেই নস্ত্রাদামুসের (Nastradamus) নাম বারবার ফিরে ফিরে আসে। ফরাসি ভবিষ্যত্দ্রষ্টা নাকি সবই আগে-ভাগে বলে গিয়েছেন! হলিউড-ছবি ‘2012’-য় চার্লি ফ্রস্ট চরিত্রটার কথা মনে আছে? নিজের ছোট্ট ‘গবেষণাগারে’ বসে বলছেন, ‘ইটস দি অ্যাপোক্যালিপস! এন্ড অফ ডেজ়।’ তার পর যা হয়েছিল, সেটা দেখতে-দেখতে কলজে ঠান্ডা হয়ে যায়নি, এমন চরিত্র কমই আছে। নস্ত্রাদামুস বা চার্লি ফ্রস্ট—দু’জনেরই সঙ্গে মুখের মিল আছে নেদারল্যান্ডসের ফ্র্যাঙ্ক হুগারবিটসের (Frank Huggerbits)। তিন জনের মুখেই একগাল দাড়ি। মিল আছে আরও একটা। তিন জনই বিপর্যয়ের পূর্বাভাস (Earthquake Prediction) দেন। ৩ ফেব্রুয়ারি হুগারবিটস একটি আশঙ্কার কথা বলেছিলেন। হুবহু মিলে গিয়েছে সেই আশঙ্কা। যার পর বিশ্ব জুড়ে শুরু হয়েছে নতুন চর্চা।
Sooner or later there will be a ~M 7.5 #earthquake in this region (South-Central Turkey, Jordan, Syria, Lebanon). #deprem pic.twitter.com/6CcSnjJmCV
— Frank Hoogerbeets (@hogrbe) February 3, 2023
ভূমিকম্পের পূর্বাভাস কি সত্যিই দেওয়া সম্ভব?
ঠিকই ধরেছেন। হুগারবিটস তুরস্কের ভয়াবহ ভূমিকম্প নিয়েই আভাস দিয়েছিলেন। কতটা ভয়াবহ, তা তুরস্ক আর সিরিয়ার মানুষ টের পাচ্ছেন। আর ভাইরাল ভিডিয়ো দেখে কেঁপে উঠছেন অন্য দেশের মানুষ। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান বলছেন, ১৯৩৯ সালের পর এমন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েনি দেশ। বিপর্যয়ই বটে! ভোররাতে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প। তার পর পরবর্তী ১২ ঘণ্টায় অন্তত ৫০টি আফটারশক। তার মধ্যে একটি আবার মূল ভূমিকম্পেরই সমান। ৭.৫ মাত্রার। রাতে ফের ৭.৬। ৬ মাত্রার উপরে ব্যাক টু ব্যাক কম্পন। একেই বোধহয় বলে, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! এই খাঁড়ার ঘা-এর উপর ভারতীয় সময় অনুসারে—মঙ্গলবার সকালে—৫.৬ মাত্রার ভূমিকম্প। শুধু তুরস্ক নয়, ধ্বংসের অভিঘাত মুছে দিয়েছে দেশ-প্রদেশের সীমানাও। কীভাবে? তুরস্ক ছাড়িয়ে সিরিয়া-লেবানন-মিশর-সাইপ্রাস অমনকী সুদূর ডেনমার্ক, গ্রিনল্যান্ড পর্যন্তও ছড়িয়ে পড়েছে কম্পন।
হুগারবিটস তো এমন আশঙ্কার কথাই বলেছিলেন! তাঁর টুইটার হ্যান্ডেলে জ্বলজ্বল করছে ৩ ফেব্রুয়ারির টুইট: ‘এখন হোক বা পরে, দক্ষিণ-মধ্য তুরস্ক, জর্ডন, সিরিয়া, লেবাননে ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে।’ হলও তাই। ঘড়ির কাঁটায় যখন ভোর ৮টে বেজে ১৭ মিনিট, তখন আক্ষরিক অর্থেই নাগরদোলার মতে দুলে ওঠে তুরস্ক এবং সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা।
ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া যায়। প্রবল বৃষ্টি, তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহ—সব পূর্বাভাস নিখুঁত ভাবে দিতে পারেন বিজ্ঞানীরা। গ্রহাণু, ধূমকেতু, উল্কা—কবে কোন পথে যাবে, তা-ও বলে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু আজও ভূমিকম্পের পূর্বাভাস অধরা।
তাহলে হুগারবিটস কী ভাবে বললেন?
উত্তর পেতে সৌরজগতে নজর রাখেন হুগারবিটস আর তাঁর প্রতিষ্ঠান ‘সোলার সিস্টেম জিওমেট্রি সার্ভে’। মানে পৃথিবীর পাতাল কেঁপে উঠবে কি না, তা জানতে বহির্বিশ্বে নজরদারি। হুগারবিটস বলেছিলেন, সৌরজগতে বিভিন্ন গ্রহের এমন অবস্থান হচ্ছে, তার বড়সড় প্রভাব পড়তে চলেছে পৃথিবীতে। তাঁর কথায়, ‘প্ল্যানেটরি জিওমেট্রি’। সোজা বাংলায়, গ্রহের জ্যামিতিক ফের! কেমন সেই জ্যামিতি? ইউটিউব ভিডিয়োয় হুগারবিটস দেখিয়েছিলেন, ৪ ফেব্রুয়ারি এক লাইনে চলে আসবে সূর্য-শনি-বৃহস্পতি। ৫ ফেব্রুয়ারি এক লাইনে থাকবে বুধ-সূর্য-ইউরেনাস। ৬ ফেব্রুয়ারি এক লাইনে চাঁদ-পৃথিবী-সূর্য, অর্থাত্ পূর্ণিমা। এমন ‘জ্যামিতি’ দেখিয়েই ভূগর্ভ চঞ্চল হয়ে ওঠার আশঙ্কা করেছিলেন হুগারবিটস। তাঁর দাবি, পুরোনো বহু ভূমিকম্পের সঙ্গে গ্রহের অবস্থানের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা।
সত্যিই কি এ ভাবে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস সম্ভব?
খড়্গপুর আইআইটির অধ্যাপক, শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কারপ্রাপ্ত ভূবিজ্ঞানী শঙ্করকুমার নাথ বলছেন, “কোথায়, কত মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে, সেটা বলা যায়। কিন্তু কবে, কখন সেই ভূমিকম্প হবে, তার আভাস দেওয়া যায় না।” হুগারবিটসের দাবি উড়িয়ে শঙ্করকুমার বলছেন, “ভূগর্ভের নীচে নিরন্তর প্লেট নড়াচড়া হচ্ছে। এর ফলে যে শক্তি জমা হয়, সেটাই ভূমিকম্প রূপে বেরিয়ে আসতে দেখি। আমার মনে হয় না এর সঙ্গে সৌরজগতের কোনও সম্পর্ক আছে। যেখানে ভূমিকম্প হয়েছে, সেটা তিন-তিনটি প্লেটের সংযোগস্থল। অ্যানাটোলিয়া প্লেট, আফ্রিকা প্লেট, আরবীয় প্লেট। এমন জায়গায় তীব্র ভূমিকম্প হতেই পারে।”
তবে কিছুটা অন্য মতও আছে। হুগারবিটসের তত্ত্ব পুরোপুরি উড়িয়ে দিচ্ছেন না আর এক ভূবিজ্ঞানী, ভারতীয় ভূতত্ত্ব সর্বেক্ষণের প্রাক্তন অধিকর্তা জ্ঞানরঞ্জন কয়াল। তিনি বলছেন, “ভূমিকম্প প্লেটের নড়াচড়ার জন্যই হয়। যেমন তুরস্কের ভূমিকম্প হয়েছে ইস্ট অ্যানাটোলিয়া ফল্টে। ভূমিকম্পের আর কোনও কারণ নেই। তবে গ্রহের অবস্থান ভূমিকম্পকে ট্রিগার করতে পারে। চাঁদের অবস্থানের জন্যই তো জোয়ার-ভাঁটা হয়। ফলে গ্রহ-উপগ্রহের অবস্থানের প্রভাব পড়বে না, এমনটা বলা যায় না। হুগারবিটসরা যা করেছেন, সেটা পরীক্ষামূলক। আরও গবেষণা দরকার।” যদিও হুগারবিটসের টুইটকে ‘প্রেডিকশন’ বলতে চান না জ্ঞানরঞ্জনবাবু। তাঁর কথায়, “পূর্বাভাস দেওয়ার অর্থ স্থান-কাল-মাত্রা—তিনটেই বলতে হবে। সেটা এক্ষেত্রে হয়নি। আশঙ্কা করেছিলেন, সেটা দিনকয়েক পর সত্যি হয়েছে। তাই একে ঠিক পূর্বাভাস বলা যায় না।”
চর্চা চলবে। যুক্তি, পাল্টা যুক্তিও চলবে। বিজ্ঞান তো এ ভাবেই এগোয়। তবে এগোনোর ফাঁকে প্রকৃতি আরও পিছিয়ে দেবে কি না, সেই আশঙ্কা থাকছেই।
হুগারবিটস বলে রেখেছেন, চলতি বছরের দ্বিতীয় ভাগেও বড়সড় ভূমিকম্পের সাক্ষী হতে পারে পৃথিবী। কবে? অগস্ট থেকে নভেম্বরের মধ্যে, আপাতত এটুকুই বলছেন হুগারবিটস। নিখুঁত পূর্বাভাস কি পাওয়া যাবে? বিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন এখন সেটাই।